পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান হিসেবে এক বছর আগে দায়িত্ব নিয়েছেন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। এ সময়ে বেশকিছু মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির আইপিওর অনুমোদন দিয়েছে কমিশন, তালিকাভুক্ত হয়েছে একটি বহুজাতিক কোম্পানিও। পাশাপাশি বাতিল করা হয়েছে বেশকিছু দুর্বল কোম্পানির আইপিও আবেদন। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক স্থিতিশীলতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে সম্প্রতি তিনি কথা বলেন দৈনিক শেয়ার বিজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ
শেয়ার বিজ: বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের এক বছর পূর্ণ হলো। এই সময়ের মধ্যে আপনাদের প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তিগুলো কী?
শিবলী রুবাইয়াত–উল–ইসলাম: প্রাপ্তি কিছুটা তো আছেই। তবে অপ্রাপ্তি অনেক আছে। যেমন আইটি নিয়ে যে ধরনের পরিকল্পনা ছিল সেভাবে এগোতে পারিনি। একইভাবে ‘জেড’ ক্যাটেগরির কোম্পানি এবং ওটিসি মার্কেট নিয়ে যে পরিকল্পনা ছিল, সেটাও ঠিকভাবে করতে পারিনি। কারণ এই সময়টাতে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা সম্ভব হয়নি। সবাই করোনার অজুহাত দেখিয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে তো অর্ধেক লোক কাজ করেছে। সবকিছু মিলে আমরা অনেক কিছুই করতে পারিনি। আর প্রাপ্তির বিষয় সেভাবে কিছু বলতে চাই না। যা হয়েছে, সবই তো আপনারা দেখেছেন।
শেয়ার বিজ: করোনাকালে আমরা আরও একটি বাজেট পাচ্ছি। বাজেটে পুঁজিবাজার নিয়ে প্রতি বছরই নানা প্রত্যাশা থাকে। এ বছর বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য কী দেখতে চান?
শিবলী রুবাইয়াত–উল–ইসলাম: বাজেটে পুঁজিবাজার নিয়ে আমাদের বেশ কিছু প্রত্যাশা রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমে রয়েছে কালোটাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ রাখা। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার আরও কমানো। এটি কমালে দেশি-বিদেশি কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসতে আগ্রহী হবে। বর্তমানে এ করহার ২৫ শতাংশ রয়েছে। আমরা চাই এটি কমিয়ে ২০ থেকে ২২ শতাংশে আনা হোক।
শেয়ার বিজ: বহুজাতিক কোম্পানির বিষয়ে আলাদা কোনো চাওয়া আছে কি না, অর্থাৎ এ ধরনের কোম্পানির কর হার আরও কম হওয়া উচিত কি না?
শিবলী রুবাইয়াত–উল–ইসলাম: বহুজাতিক কোম্পানির জন্য আলাদা কোনো চাওয়া নেই। সবার জন্যই করহার ২০ থেকে ২২ শতাংশ হলেই মনে হয় তারা পুঁজিবাজারের প্রতি আগ্রহী হবে।
শেয়ার বিজ: সম্প্রতি বিএসইসি থেকে ৩০টি ব্রোকারেজ হাউসের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আরও কিছু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। একসঙ্গে এতগুলো হাউস অনুমোদন দেয়ার মূল উদ্দেশ্য কী?
শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম: বর্তমানে যে হাউস রয়েছে (২৫০টি) এর মধ্যে ১২টি বন্ধ। আর ১৩৬-১৩৭টির পারফরম্যান্স ভালো নয়। তাদের যে পরিশোধিত মূলধন তাও ইনভেস্ট করে না। তাদের ব্যবসায়িক ফোকাস আসলে অন্যদিকে। এভাবে চললে তো আমার পরিকল্পনা-মাফিক এগোতে পারব না। সে কারণে নতুন সদস্য যোগ করা হয়েছে। তাছাড়া দীর্ঘদিন নতুন কোনো হাউসের অনুমোদন বন্ধ রয়েছে। সবকিছু মিলেই নতুন সদস্যপদের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
শেয়ার বিজ: সম্প্রতি পুঁজিবাজার ভালো অবস্থানে রয়েছে। লেনদেন ও বাজার মূলধন ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশে পুঁজিবাজারের যে আকার সেদিক বিবেচনা করলে দৈনিক লেনদেন কত হওয়া উচিত?
শিবলী রুবাইয়াত–উল–ইসলাম: এটা বলা মুশকিল। লেনদেন যত বেশি হবে ততই ভালো। তবে কত কোটি টাকা উচিত, তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। আমি বলতে চাইও না। তবে লেনদেন বেশি হলে সবার জন্য ভালো। আমরা যে নতুন হাউসগুলোর অনুমোদন দিলাম, এখানে অনেক কর্মসংস্থান হবে। লেনদেন বেশি হলে তাদের আয় বাড়বে। হাউসগুলো সুন্দরভাবে চলতে পারবে। তবে আমাদের পুঁজিবাজারে যখন বন্ডগুলো নিয়মিত লেনদেন হবে তখন লেনদেন আরও বাড়বে।
শেয়ার বিজ: আমরা সবসময় শুনে থাকি পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করা উচিত। নিয়মানুযায়ী সেটাই হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা এর উল্টো চিত্র দেখতে পাই। বিনিয়োগকারীরা ঘনঘন পোর্টফলিও পরিবর্তন করেন। এটা কতটা যুক্তিযুক্ত?
শিবলী রুবাইয়াত–উল–ইসলাম: সবাই এমনটা করে না। আমার মনে হয় এ সংখ্যা কম। তবে যারা ঘনঘন পোর্টফলিওতে পরিবর্তন আনেন তারাও কেউ কেউ লাভ করেন। কেউ লাভ পেলে তো অবশ্যই পোর্টফলিওতে পরিবর্তন আনবেন। এ রকম করতে গিয়ে অনেকে আবার লোকসানও করেন। লোকসান করে আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা কথাও বলেন। আসল কথা হচ্ছে এটা যার যার ব্যাপার। শেয়ার বিজ: ২০১০ সালের পর পুঁজিবাজারের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্য আমরা ডিমিউচুয়ালাইজেশন স্টক একচেঞ্জ পেয়েছি। এখন কী বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে বিশ্বমানের পুঁজিবাজার ধরা যায়?
শিবলী রুবাইয়াত–উল–ইসলাম: এখনও আমাদের পুঁজিবাজারকে বিশ্বমানের পুঁজিবাজার বলা যায় না। কারণ অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনায় আমাদের পুঁজিবাজার অনেক পিছিয়ে রয়েছে। সেই বিবেচনায় বলতে গেলে আমাদের বাজার এখনও বিশ্বমানের পুজিবাজারের ২০ শতাংশও হয়নি। এর জন্য সময়ের দরকার।
শেয়ার বিজ: এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। করোনাকালে প্রথম থেকেই বিমা খাতের আধিপত্য বিস্তার করতে দেখা যাচ্ছে, যা এখন চলমান। আপনার দৃষ্টিতে এর বিশেষ কোন কারণ রয়েছে কি না?
শিবলী রুবাইয়াত–উল–ইসলাম: এর পেছনে তেমন কোনো কারণ আছে বলে মনে করি না। মূলত বিমা খাতের কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন কম, ১৫-২০ কোটি টাকা। এ ধরনের কোম্পানির শেয়ারদর সহজে বাড়ে। সে কারণেই বিনিয়োগকারীরা এ ধরনের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। যেখানে লাভ থাকবে বিনিয়োগকারী তো সেখানেই যাবেন? এখন যেমন বিমা ছেড়ে ব্যাংকের দিকে ঝুঁকেছেন বিনিয়োগকারীরা। এটা আসলে তাদের পছন্দের বিষয়।
শেয়ার বিজ: দীঘদিন থেকে ডিএসইর এমডি নিয়োগ নিয়ে জটিলতা চলছে। তারা যোগ্য প্রার্থী পাচ্ছেন না। ডিএসইতে কেমন এমডি দেখতে চায় বিএসইসি?
শিবলী রুবাইয়াত–উল–ইসলাম: আমরা যোগ্য লোক চাই, যিনি পুঁজিবাজার ভালো বুঝবেন, অর্থাৎ বাজার সম্পর্কে যার ভালো ধারণা রয়েছে। বিদেশের পুঁজিবাজার সম্পর্কে যার ধারণা রয়েছে বা সেখানে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে, এমন কেউ হলে আরও ভালো। এটা একটা বড় দায়িত্ব, সে কারণে যোগ্য প্রার্থীর বিকল্প নেই।
শেয়ার বিজ: বর্তমান পুঁজিবাজার পরিস্থিতি নিয়ে বিনিয়োগকারীদের কী বলবেন?
শিবলী রুবাইয়াত–উল–ইসলাম: এখন পুঁজিবাজার অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। পুঁজিবাজার এখন বিনিয়োগের সর্বোচ্চ উৎকৃষ্ট জায়গা। আমরাও এর নিরাপত্তা দেয়ার চেষ্টা করছি। তারা নির্ভয়ে এখানে বিনিয়োগ করতে পারেন। এখন পুঁজিবাজার মানি মার্কেট থেকে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। তবে বিনিযোগকারীদের ভালো মানের কোম্পানির পাশাপাশি ভালো পোর্টফলিও ম্যানেজারের মাধ্যমে বিনিয়োগ করতে হবে। তারা ধৈর্য ধরে বিনিয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব।
শেয়ার বিজ: সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
শিবলী রুবাইয়াত–উল–ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।