Print Date & Time : 4 July 2025 Friday 6:15 pm

তিতুমীর কলেজের শিক্ষক কামরুল হাসানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকারি তিতুমীর কলেজের গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল হাসানের বদলির দাবি করেছেন ওই বিভাগের শিক্ষার্থীরা। কামরুল হাসানের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারিতা, ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান, বিভাগীয় প্রধান হয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের দেখে নেওয়ার হুমকি, ক্লাসে একাডেমিক পড়া বাদ দিয়ে অযাচিত আলোচনা, বিবাহিত-গর্ভবতী ছাত্রীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য, বিগত বছরে ছাত্রলীগের হয়ে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের হুমকি দেওয়া সহ তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিয়েছেন গণিত বিভাগের শিক্ষার্থীরা।

অভিযোগ নিয়ে বারবার কলেজ প্রসাশনের দারস্থ হন শিক্ষার্থীরা। দিয়েছেন লিখিত অভিযোগ এবং গণ স্বাক্ষরও তবে কোন সমাধান পাননি শিক্ষার্থীরা। দ্রুত তাকে তিতুমীর কলেজ থেকে বদলি চান ওই বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
উল্লেখ্য, মোহাম্মদ কামরুল হাসান ২০০৯ সালে তিতুমীর কলেজের গণিত বিভাগে যোগদান করেন। এরপর ১৫ বছর ধরে তিনি এই ডিপার্টমেন্টে রয়েছে। ২০২১ সালের জুলাই মাসে তিনি সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন এবং তাকে ইনসিটু করা হয়। কিন্তু তিনি তিতুমীর কলেজেই থেকে যান, নতুন করে তার পদায়ন হয়নি। বিগত বছরগুলোতে তার নামে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ দিলেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। তিনি তার ক্ষমতার দাপট দেখাতেন।

শিক্ষার্থীরা জানায়, ছাত্রআন্দোলনের সময় বিভাগের শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে থাকা, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের বিভিন্ন তথ্য পুলিশ ও ছাত্রলীগকে প্রদান করা কামরুল হাসান ১২ আগস্ট ডিপার্টমেন্টে আসলে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন। শিক্ষার্থীরা তার ক্লাস করতে অসম্মতি জানিয়ে তাকে বিভাগ থেকে বদলি হওয়ার আহবান জানায়। সেদিন তিনি লিখিতে দেন উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তিতুমরি কলেজ থেকে বদলি হওয়ার। এরপর ২২ আগস্ট তিনি ক্লাস নিতে ক্লাসরুমে গেলে শিক্ষার্থীরা তার ক্লাস না করার কথা জানান। সেদিন তিতুমীর কলেজের তৎকালীন ভারপ্রপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো: মহিউদ্দিন, শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক অধ্যাপক কাজী ফয়জুর রহমানের উপস্থিতিতে বিভাগের একাধিক শিক্ষক ও সকল বর্ষের শিক্ষার্থীদের নিয়ে মতবিনিময় করা হয়। সেখানে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা কামরুল হাসানের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ তুলে ধরেন। এবং তার ক্লাস না করার বিষয়ে মত দেন। পরবর্তীতে অভিযোগগুলো লিখিত জমা দেন শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়ে দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দিলেও কোন সমাধান পায়নি শিক্ষার্থীরা।

পরবর্তীতে বর্তমান অধ্যক্ষ অধ্যাপক শিপ্রা রানী মন্ডল নিয়োগ পাওয়ার পর তার কাছে গিয়ে গণিত বিভাগের শিক্ষার্থীরা কামরুল হাসানের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ ও তার বদলির দাবির বিষেয়ে জানান। এবং সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল হাসানের বদলির প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সকল বর্ষের শিক্ষার্থীদের চারশতের অধিক গণ স্বাক্ষর ও তাদের অভিযোগগুলি সহ লিখিত অভিযোগ গণিত বিভাগের বর্তমান বিভাগীয় প্রধানের মাধ্যমে অধ্যক্ষর কাছে পাঠান। তবে শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে সমাধানের আশ্বাস দিলেও, আজানা কারণে লিখিত আভিযোগ তিনি গ্রহণ করেনি।
এদিকে শিক্ষার্থীদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরও কামরুল হাসানের বিরুদ্ধে দেয়া লিখিত অভিযোগ অধ্যক্ষ গ্রহণ না করায়, তিনি বিভাগের কার্যক্রমে অংশ না নিলেও কলেজে আসছেন নিয়মিত। অংশ নিচ্ছেন নিয়মিত কলেজের প্রোগ্রামগুলোতে।

সহযোগী অধ্যাপক জনাব মোহাম্মদ কামরুল হাসান স্যারের বিরুদ্ধে অভিযোগ সমূহ হলো- ১. বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান। ২. ল্যাব ও ভাইভাতে নির্দিষ্ট শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে নম্বর কমিয়ে দেওয়া। ৩. ভবিষ্যতে বিভাগীয় প্রধান হয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের দেখে নেওয়ার হুমকি। ৪. ক্লাসের পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আলোচনা করা। ৫. ক্লাসে খুবই বদমেজাজী আচরণ করা। ৬. বিশেষ করে গর্ভবতী তী ছাত্রীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা।
৭। বিবাহিত ছাত্রীদের ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ ও অপমান করা। ৮. হুজুরদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা (দাড়ি, টুপি, পাঞ্জাবীকে হেয় করে দেখা)। ৯. শিক্ষার্থীদের সামান্য ভুলের জন্য অবিভাবকদের ফোন দিয়ে অপমান করা। ১০. ছাত্রলীগের হয়ে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের হুমকি দেওয়া। ১১. পরীক্ষার হলে তার অপমানে শিক্ষার্থীর অজ্ঞান হওয়ার নজির রয়েছে। ১২. ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের অপমান করা।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণিত বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরাসরি বিপক্ষে অবস্থান করেছে। স্যার স্টুডেন্টদের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ক্লাসে অপনান করতো। ডিপার্টমেন্ট হেড হয়ে সবাইকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিতো। পরীক্ষায় দেখে নেওয়ার হুমকি দিতো। বিবাহিত ও গর্ভবতী মেয়ে শিক্ষার্থীদের বিয়ে নিয়ে ক্লাসে দাড় করিয়ে কটুক্তি করতো। স্যার ক্লাসে না পড়িয়ে তার পারিবারিক গল্প বলতো। আমাদের ক্লাসের হুজুর শিক্ষার্থীদের নিয়ে কটুক্তি করতো।

চাকরিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের ডকুমেন্টস তার কাছে সত্যায়িত করতে নিয়ে গেলে সত্যায়িত না করে উল্টো অপমান করতো। ক্লাসে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মানসিক ভাবে অপদস্ত করতো এমনকি তার এ অপমানে ক্লাস শিক্ষার্থী অজ্ঞান হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে।

আরেক শিক্ষার্থী জানান, শিক্ষার্থী হিসেবে আমার প্রথম অভিযোগ হলো স্যার ক্লাসে একাডেমিক পড়াশুনার চেয়ে অপ্রাসঙ্গিক আলাপে সময় অপচয় বেশি করে। কোনো শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত সমস্যা হাইলাইট করে তাকে অপমান করে। শিক্ষার্থীদের সাথে স্যারের বেশিরভাগ আচরণই অশোভনীয়। এমনকি পরীক্ষার সময়েও স্যারের আচরণ শিক্ষার্থীদের বিরক্তির কারণ।

দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলাম জানান, আমাদের ২য় বর্ষের টেস্ট পরীক্ষা চলছিলো। ওইদিন আমাদের ননমেজর পদার্থবিজ্ঞানের ৩ টা কোর্সের একসাথে পরীক্ষা হচ্ছিলো। আমার এক বন্ধু তার বাবাকে হাসপাতালে রেখে পরীক্ষা দিতে আসছে। ও কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসছে যে এখানে যেই বড় হাসপাতাল গুলো আছে কোনোভাবে একটা সিটের ব্যবস্থা করতে পারে কিনা। কারণ ওর আব্বু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। ও আসলো পেলো না, আমাদের সাথে কথা বলতে ক্যাম্পাস এলো। পরে ভাবলো এক্সামে রোল টা লিখে দিয়ে যাক আর পারলে এক্সাম টাও দিয়ে যাক। কিন্তু ও আমার এক বেঞ্চ আগেই বসছিলো ও কোনোভাবেই ওর আব্বুর চিন্তায় লিখিতে পারছে না তাই খাতা টা জমা দিতে গেলো। তখন স্যার সে খাতা নিলো না বললো, ফাঁকিবাজি করতে আসো কলেজে। আমার বন্ধু বললো স্যার আমার আব্বু অসুস্থ আমাকে যেতে হবে এক্সাম দিতে পারবো না। তখন স্যার বললেন এইসব ফাঁকিবাজি আমার কলেজে চলবে না। বললো, তোমার আব্বুকে ফোন দাও কথা বলবো। একটা বিষয় দেখেন অনার্স পড়ুয়া স্টুডেন্ট কে তার বাসায় ফোন দিচ্ছে। আচ্ছা এরপর ও বললো স্যার আব্বু অসুস্থ এইটাইমে ফোন না দিলেই নয়। স্যার কোনো কথাই শুনবে না। নানান ভাবে অপমান করতে লাগল।

তৃতীয় বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, সেকেন্ড ইয়ারের ইনকোর্স পরিক্ষা চলছিলো। তখন বিএনপি বা কোন দল হরতালের ডাক দেয়। পুরো ঢাকা শহর মোটামু্টি পরিবহন চলাটা কষ্টকর ছিলো। তাই আমাদের গ্রুপে আমি, রায়হান উল্ল্যেখযোগ্যভাবে পরিক্ষা বন্ধ রাখার পক্ষে কথা বলি। কারণ মিছিলের মধ্যে আসাটা চ্যালেঞ্জিং ছিলো।এরপরদিন যথারীতি পরিক্ষা দিতে আসি (মিছিল ত্রিশ ফিট দূর ছিলো,অল্পের জন্য পরিক্ষা মিস করতাম)।পরিক্ষার হলে এসে হোয়াটস্যাপের মেসেজ খুঁজে বের করে আমাদের ডিপ্টের হেডের রুমে নিয়ে যায়। তারপর দেশদ্রোহী, বিএনপির মদদদাতা যা খুঁশি তা বলে। পরে রায়হানরে বলে পরিক্ষা কেমনে দিবি দেখা যাবে। এরপর তিনি কথা শোনায়। পুরো কথাটা সংক্ষেপে বললাম। তিনি এক কথায় বলতে চাচ্ছিলো আমরা দলগুলোকে সমর্থন দিচ্ছি। এই হলো কামরুল স্যার,আমাকে চারিত্রিক সার্টিফিকেট ধরায় দিচ্ছিলো রীতিমত।

২১-২২ সেশনের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের ইনকোর্সের সময় আমি পরীক্ষার পেপার আগে জমা দেওয়ায়, স্যার কারণ জিজ্ঞেস করায় আমি বললাম যে স্যার সমস্যা আছে আমাকে যেতে হবে। তখন স্যার আমার উপর রাগ হয়ে গেলেন। আমার কাজ ওনাকে সরাসরি বলতে হবে, স্যার ওপেন থ্রেট দিয়েছিলেন আমি তোমাকে হাতে মারবো না, ভাতে মারবো। তোমাকে ফাইনালে বসতে দিবো না তেমার রোল রেজিষ্ট্রেশন নিয়া গেলাম তুমি আমার সাথে বেয়াদবি করো ওনি আমার বাসায় ফোন দিয়াও উল্টাপাল্টা কথ বললেন।

মনির নামে ২০-২১ সেশনের আরেক শিক্ষার্থী জানান, কামরুল স্যারের বিরুদ্ধে আমার বেশ কয়েকটি অভিযোগ আছে ,তার মধ্য অন্যতম হলো, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশে প্রচুর অরাজকতা চলতেছিল, হরতাল অবরোধ ইত্যাদি। ওই সময় আমাদের ইনকোর্স পরীক্ষা চলতেছিল। তো আমি সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাদের ডিপার্টমেন্ট গ্রুপে এক্সাম টাইম সকাল থেকে দুপুরে নেওয়ার জন্যে আমাদের মেইন গ্রুপে একটা মেসেজ দেই। স্যার সেটার স্ক্রিনশট নিয়ে রাখে। এবং পরদিন পরীক্ষার সময় আমাকে শুরুতেই খুঁজে বের করে। তারপর পুরা ৪৫ মিনিট আমাকে সবার সামনে দাড়িয়ে রেখে ইচ্ছা মত বকা দেন। একটুও লেখার সুযোগ দেয় নাই পরীক্ষায়। প্রচণ্ড চিল্লা-চিল্লি শুরু করে আমার উপর। শেষ পর্যন্ত আমি পরীক্ষা দিতেই পারি নাই। ঐটার জন্য আমার ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্টেও ইফেক্ট পরে। সব চেয়ে বড় কথা ওইদিন পরীক্ষার হলে আমি প্রায় কান্না করতেছিলাম। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। সবার সামনে একদম লজ্জা ও ভয়ে কান্না করা ছাড়া উপায় ছিলো না। এছাড়াও কামরুল স্যার ক্লাসে ঠিক মত পড়ায় না। পুরো ক্লাস টাইম নিজের এবং পরিবারের গল্প শোনায় আমাদেরকে।