পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে অনিয়ম

তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ে দুদকের চিঠি

নজরুল ইসলাম: আবাদি জমিকে বাস্তু হিসেবে দেখিয়ে রোয়েদাদ প্রস্তুত। জমি মালিকদের প্রকৃত ক্ষতিপূরণের চেয়ে অতিরিক্ত টাকা পরিশোধ। সরকারি টাকার ক্ষতিসাধন। সরকারি কর্মচারী হিসেবে সরকারের স্বার্থ রক্ষায় দায়িত্ব পালনে গাফিলতি, দুর্নীতি ও অসদাচরণ। এমন সব ঘটনাই ঘটেছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের যশোর জেলার সদর উপজেলা অংশের ভূমি অধিগ্রহণে। এক অনুসন্ধানে বসুন্দিয়া ইউনিয়নের ঘুনি মৌজায় ঘটা এমন চিত্র পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

ঘটনার সঙ্গে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের তিন কর্মকর্তা, দুই সার্ভেয়ার ও একজন কানুনগোর সম্পৃক্ততা পেয়েছে দুদক। সংস্থাটির সচিব মাহবুব হোসেন স্বাক্ষরিত ২০ ডিসেম্বর এক চিঠিতে প্রশাসন ক্যাডারের তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠিও পাঠানো হয়েছে।

এ তিন কর্মকর্তা হলেন যশোর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সেই সময়ের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা বর্তমানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (প্রশাসন-১) রোসলিনা পারভীন (পরিচিতি নম্বর ১৭৪১৮), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বর্তমানে সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর (শ্রম) মোহাম্মদ রেজায়ে রাব্বী (পরিচিতি নম্বর ১৫৫৪৭) ও ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা বর্তমানে বরগুনা জেলার পাথরঘাটার ইউএনও সুফল চন্দ্র গোলদার (পরিচিতি নম্বর ১৭৪১১)। বিসিএস ৩৩ ব্যাচের এ কর্মকর্তা ২০২২ সালের ২৩ আগস্ট পাথরঘাটায় যোগ দেন। তার আগে তিনি ২০২০ সালের ১৬ জুন থেকে ২০২২ সালের ১ আগস্ট পর্যন্ত ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ায় ইউএনও ছিলেন।

দুদকের চিঠিতে বলা হয়, আরএস ৪৩৮৯ নম্বর দাগে ধানি শ্রেণির ২.২২ একর জমির মধ্যে ১.২৯ একর জমি এবং বাস্তু শ্রেণির ২৬ শতক জমির মধ্যে ৩.৪০ শতক জমি অধিগ্রহণের জন্য নির্বাচন করা হয়। অধিগ্রহণ করা ১.২৯ একর ধানিজমিকে বাস্তু হিসেবে দেখিয়ে রোয়েদাদ প্রস্তুত করা হয়। রোয়েদাদে স্বাক্ষর করেন সার্ভেয়ার জাহিদুল ইসলাম, কানুনগো আসলাম আলী, ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা রোসলিনা পারভীন ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ রেজায়ে রাব্বী। ধানিজমিকে বাস্তু হিসেবে দেখিয়ে জমির মালিক হোসায়েন আলীকে ১ কোটি ২১ লাখ ৯৯ হাজার ৫৭৮ টাকা ও আশরাফ আলীকে ২ কোটি ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ৩৬৭ টাকা দেয়া হয়। জমির অতিরিক্ত মূল্য হিসেবে হোসায়েন আলীকে ৫০ লাখ ৭১ হাজার ৮৬২ টাকা ও আশরাফ আলীকে ৯৭ লাখ ৯৭ হাজার ৯১৬ টাকাসহ মোট ১ কোটি ৪৮ লাখ ৬৯ হাজার ৭৭৮ টাকা দেয়া হয়। প্রকৃত  ক্ষতিপূরণের চেয়ে অতিরিক্ত টাকা দেয়ার বিষয়টি উদঘাটিত হলে হোসায়েন আলী ও আশরাফ আলীর বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা (নম্বর ২৬/২০২১) দায়ের করা হয়। পরে তারা উৎসে কর বাদে ১ কোটি ৪৭ লাখ ২০ হাজার ১৮৬ টাকা চালান মূলে সরকারি কোষাগারে জমা দেন।

দুদক অনুসন্ধানে পেয়েছে, অভিযোগ সংশ্লিষ্ট সার্ভেয়ার দেলোয়ার হোসেন, সার্ভেয়ার জাহিদুল ইসলাম, কানুনগো আসলাম আলী, ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা রোসলিনা পারভীন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ রেজায়ে রাব্বী ও ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা সুফল চন্দ্র গোলদার সরকারি কর্মচারী হিসেবে সরকারের স্বার্থ রক্ষায় তাদের দায়িত্ব পালনে গাফিলতি, দুর্নীতি ও অসদাচরণের মাধ্যমে জমির মালিকদের অতিরিক্ত ১ কোটি ৪৮ লাখ ৬৯ হাজার ৭৭৮ টাকা দিয়ে সরকারের আর্থিক ক্ষতিসাধন করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। এছাড়া ভূমি অধিগ্রহণ খাতের উৎসে কর বাবদ ১ লাখ ৪৯ হাজার ৫৯১ টাকা স্থানান্তর হওয়ার বিষয়েও সরকারি কর্মচারী হিসেবে তারা চরম অদক্ষতা দেখিয়েছেন। সে হিসেবে যশোর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এলএ শাখার সার্ভেয়ার জাহিদুল ইসলাম ও দেলোয়ার হোসেন, কানুনগো আসালাম আলী, যশোর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা রোসলিনা পারভীন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ রেজায়ে রাব্বী ও ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা সুফল চন্দ্র গোলদারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে দুদক কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে রোসলিনা পারভীন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘‘এটা ক্ল্যারিকেল মিসটেক’। কাজ করতে গেলে ‘ক্ল্যারিকেল মিসটেক’ হয়ই। পরে তারা টাকা ফেরতও দিয়েছে।’’

অভিযোগের বিষয়ে সুফল চন্দ্র গোলদার শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমি দুই বছর আগে সেখান থেকে চলে এসেছি। আমার কোনো মন্তব্য নেই। সার্টিফিকেট মামলা করে টাকা ফেরতও দিয়ে এসেছি।’ অভিযোগের বিষয়ে মুহাম্মাদ রেজায়ে রাব্বী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘যশোর জেলায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) হিসেবে আমি ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর তারিখে অবমুক্ত হয়ে ৮ সেপ্টেম্বর তারিখে সেতু বিভাগে যোগদান করি। কিন্তু আমি অবমুক্ত হওয়ার প্রায় ৪ মাস পর ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর তারিখে তৎকালীন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা (যিনি আমি অবমুক্ত হওয়ার পর যশোর কালেক্টরেটে যোগদান করেছেন) ভুলক্রমে এলএ ০৬/২০১৭-১৮ নম্বর অধিগ্রহণ কেসে যশোর জেলার ২৩৩ নম্বর ঘুনি মৌজার  ৪৩৮৯  নম্বর দাগের ১.৩২৪০ একর জমি ভুলক্রমে ধানি শ্রেণির পরিবর্তে বাস্তু শ্রেণি গণ্য করে ভূমি মালিক হোসেন আলী ও আশরাফ আলীকে বেশি টাকা পরিশোধ করেন। এর ফলে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে মর্মে দুদক তদন্ত করে। ইতোমধ্যে ভুলক্রমে প্রদত্ত টাকা আদায়ের জন্য আইন অনুযায়ী ২৬/২০২১ নম্বর সার্টিফিকেট মামলা রুজু করে জমির মালিককে নোটিশ করা হলে তিনি এক সপ্তাহের মধ্যে পুরো টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেন। এর ফলে সরকারের কোনো আর্থিক ক্ষতি হয়নি। দুদকের তদন্তে দুর্নীতির বিষয়টি প্রমাণিত না হওয়ায় এবং সরকারের আর্থিক কোনো ক্ষতি না হওয়ায় দুদক কোনো মামলা বা কার্যধারা গ্রহণ করেনি। ঘটনাটি আমি যশোর জেলা থেকে অবমুক্ত হওয়ার ৪ মাস পরের ঘটনা। এর সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।’