Print Date & Time : 27 August 2025 Wednesday 1:03 pm

তিন থেকে ছয় মাস কিস্তি না দিলেই খেলাপি হবে ঋণ

কিস্তি পরিশোধের তারিখ পার হলেই হবে মেয়াদোত্তীর্ণ

সব ঋণে অভিন্ন প্রভিশন রাখতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক: আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা ব্যাসেল-৩-এর আলোকে ঋণ শ্রেণিকরণ ও প্রভিশন নীতিমালা কঠোর করল বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী এপ্রিল থেকে চলতি বা মেয়াদি সব ঋণের কিস্তি পরিশোধের তারিখ পার হলেই তা মেয়াদোত্তীর্ণ ধরা হবে। ২০১৯ সাল থেকে মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে ছয় মাস পর থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ হচ্ছিল। আগামীতে তিন থেকে ছয় মাস কিস্তি না দিলেই শ্রেণিকৃত ঋণের প্রথম পর্যায় সাব-স্ট্যান্ডার্ড তথা নিম্নমানের খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবে ঋণ। বর্তমানে ৯ মাস পর্যন্ত সাব-স্ট্যান্ডার্ড বিবেচিত হয়। এছাড়া সব ধরনের ঋণের বিপরীতে প্রভিশনিংয়ের হার অভিন্ন করা হয়েছে। গতকাল ঋণ শ্রেণিকরণ ও প্রভিশনিং-বিষয়ক সমন্বিত নির্দেশনা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণে ঋণ শ্রেণিকরণের নীতিমালায় এমন কঠোরতা আনা হয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো ঋণ ছয় মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলেই তা খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হয়। এই আইনে কোনো পরিবর্তন না এনে ২০১৯ সালের এপ্রিলে এক নির্দেশনার মাধ্যমে কৌশলে খেলাপি কম দেখানোর সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের পরামর্শে জারি করা সার্কুলারে বলা হয়, মেয়াদি ঋণ বকেয়া হিসাবের ক্ষেত্রে বাড়তি ছয় মাস সময় পাবে। এর মানে কিস্তি পরিশোধের শেষ তারিখের ছয় মাস পর থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ গণনা করা হবে। এই নিয়মে প্রকৃতপক্ষে এক বছর পর খেলাপি হচ্ছে। অবশ্য এরই মধ্যে এই নিয়ম কিছুটা কঠোর করা হয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক থেকে তিন মাস পর থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ গণনা করা হচ্ছে। এছাড়া আগের মতো নির্দিষ্ট আইনজীবীদের মাধ্যমে আদালতে গেলেই স্থগিতাদেশ মিলছে না। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঢালাওভাবে কোনো বিশেষ সুযোগ দিচ্ছে না।
আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতে সব ধরনের ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে হয়। যত বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ হবে, তত বেশি প্রভিশন রাখার নিয়ম রয়েছে। এক্ষেত্রেও বিভিন্ন শিথিলতা ছিল। আর ঋণ বিতরণের সময়ও প্রভিশন রাখতে হয়, যা সাধারণ প্রভিশন হিসেবে বিবেচিত। বর্তমানে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে দুই শতাংশ প্রভিশন রাখার বিধান ছিল। আগামী এপ্রিল থেকে সব ধরনের নিয়মিত ঋণের প্রভিশন রাখতে হবে এক শতাংশ। এতদিন ভিন্ন ভিন্ন প্রভিশনিংয়ের কারণে অনেক ব্যাংক এক খাতের ঋণ আরেক খাতে দেখানোর মতো অনিয়ম করে আসছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতামালা অনুযায়ী, একটি ঋণ বকেয়া হওয়ার তিন মাসের আগ পর্যন্ত শ্রেণিকৃত হওয়ার আগের অবস্থা তথা স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট (এসএমএ) হিসেবে বিবেচিত হয়। এ ধরনের ঋণের ক্ষেত্রে প্রভিশন রাখতে হবে এখনকার মতোই পাঁচ শতাংশ। এছাড়া তিন থেকে ছয় মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলে এখন থেকে একটি ঋণ সাব-স্ট্যান্ডার্ড বিবেচিত হবে। এ ধরনের ঋণে প্রভিশন রাখতে হবে ২০ শতাংশ। ছয় মাসের পর থেকে ১২ বছর পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ ডাউটফুল বা সন্দেহজনক ঋণে ৫০ শতাংশ এবং ১২ মাসের বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ মন্দা বা ক্ষতিজনক মানের ঋণে প্রভিশন রাখতে হবে শতভাগ। ব্যাংকগুলোর অর্জিত মুনাফা বা উদ্যোক্তাদের জোগান দেয়া মূলধন থেকে এই প্রভিশন রাখতে হয়। কোনো ঋণ আদায় হওয়ার আগ পর্যন্ত এই প্রভিশন আয় খাতে নেয়া যায় না। অবশ্য বিগত সরকারের সময়ে ডেফারেল সুবিধা নিয়ে কোনো প্রভিশন না রেখেও অনেক ব্যাংক লভ্যাংশ দেয়ার সুযোগ হয়েছে।

আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় ১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম ঋণ শ্রেণিকরণ ও প্রভিশনিং নীতিমালা করা হয়। আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরে ধাপে ধাপে ১৯৯৮ ও ২০০৬ সালে মাস্টার সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ ২০১২ সালে ঋণ শ্রেণিকরণ ও প্রভিশনিং নীতিমালা করে মাস্টার সার্কুলার করা হয়। তবে পরে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে নীতিমালায় ব্যাপক শিথিলতা আনা হয়। এখন আবার আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে ১২ বছর পর সার্কুলার করা হলো। আর্থিক খাত সংস্কারে বিশ্বব্যাংক সহায়তার অন্যতম একটি শর্ত ছিল এই নীতিমালাকে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা।