নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ আর্থিক চাপে সতর্ক অবস্থান নেওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ নিলামে ৯১ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদহার বেড়ে ১২.১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এটি দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ হার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সোমবারের নিলামে সুদের হার ২ জুনের তুলনায় ৮ বেসিস পয়েন্ট বেশি। ২ জুনের নিলামে এই হার ছিল ১২.০২ শতাংশ।
মে মাসের তুলনায় এই বৃদ্ধি আরও বড়—সুদের হার ৪৫ বেসিস পয়েন্ট বেড়েছে।
নিলামে দীর্ঘমেয়াদি ট্রেজারি বিলগুলোর সুদের হারও বেড়েছে। গত এক মাসে ১৮২ দিনের বিলের হার ৬০ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে ১২.১১ শতাংশে উঠেছে, আর ৩৬৭ দিনের বিলের হার বেড়েছে ৬২ বেসিস পয়েন্ট।
খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঊর্ধ্বগতির মূল কারণ লিকুইডিটি স্ট্রেস-এর (তারল্য কমা) আশঙ্কা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১৪ দিনের রিপারচেজ অ্যাগ্রিমেন্ট বা পুনঃক্রয় চুক্তি (রেপো) ও ‘অ্যাশিউর্ড লিকুইডিটি সাপোর্ট (এএলএস)’ সুবিধা আগামী জুলাই থেকে বন্ধ হয়ে যেতে পারে—এমন একটি জোরালো সম্ভাবনা।
ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান এবং নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে এক বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, ধাপে ধাপে ১৪ দিন ও ২৮ দিন মেয়াদি রেপো ঋণ সুবিধা তুলে নেওয়া হবে। এরই মধ্যে ২৮ দিনের রেপো সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
রিপারচেজ অ্যাগ্রিমেন্ট বা পুনঃক্রয় চুক্তি (রেপো) মূলত স্বল্পমেয়াদি ঋণের একটি ধরন, যা সাধারণত সরকারি সিকিউরিটিজে হয়। এতে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তাদের সিকিউরিটিজ বিক্রি করে এবং চুক্তি অনুযায়ী এক বা দুই দিনের মধ্যে তা কিছুটা বেশি দামে কিনে নেয়।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। দুর্বল ব্যাংকগুলো থেকে ডিপোজিট সরিয়ে গ্রাহকরা শক্তিশালী ব্যাংকগুলোতে জমা রাখায় চাপ আরও বেড়েছে। ফলে দুর্বল ব্যাংকগুলো তারল্য ধরে রাখতে পারছে না।
তিনি বলেন, এ কারণে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডের নিলামে অংশগ্রহণ কমেছে।
মাহবুবুর রহমান জানান, যদি জুলাইয়ে ১৪ দিনের রেপো সুবিধা বন্ধ হয়, তবে অনেক ব্যাংকের জন্য তারল্য ম্যানেজমেন্ট আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়বে।
বিভিন্ন ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, ব্যাংকগুলো সাধারণত সিআরআর পূরণে কিছু নির্দিষ্ট তারল্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখে। সেই তারল্যের বড় অংশই বিভিন্ন মেয়াদে রেপোর মাধ্যমে ধার করা হয়ে থাকে।
তারা বলেন, ১৪ দিনের রেপো বন্ধ হলে ব্যাংকগুলোকে জমার ভিত্তিতে প্রাপ্ত তারল্যের ওপর নির্ভর করতে হবে। এতে স্বল্পমেয়াদি অর্থ ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে যাবে। তাই এখন ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল ও বন্ড কেনায় বাড়তি সতর্কতা নিচ্ছে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লিকুইডিটি সুবিধাগুলো ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনা হচ্ছে।
তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার আরও বাড়তে পারে, ফলে সরকারের সুদ ব্যয়ও বাড়বে।
এক শীর্ষ বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, এই অস্থির সময়ে ১৪ দিনের রেপো সুবিধা বন্ধ করা উচিত হবে না।
তিনি বলেন, এখন লিকুইডিটি সহায়তা কমালে ব্যাংক খাতের সংকট আরও গভীর হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখতিয়ার থাকলেও, এই মুহূর্তে এমন পদক্ষেপ নেওয়া যৌক্তিক কি না তা ভাবা উচিত।
তিনি সরকারকে স্বল্পমেয়াদি ঋণের প্রতি মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে যেহেতু সুদের হার অনেক বেশি, তাই সরকারের ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদি বন্ড ইস্যু না করাই ভালো। এর বদলে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিলে দীর্ঘমেয়াদে বেশি সুদ গুনতে হবে না।’