তিশা মণ্ডল: নদীভাঙন-প্রবণ এলাকায় শান্তি বেগমের বাড়ি। নামে শান্তি হলেও বাস্তবে তার সংসার ছিল দুঃখ, কষ্ট আর ঋণে ভরপুর। পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব এ নারী তিন সন্তানের জননী। স্বামী দিনমজুর। দরিদ্র বাবা অল্প বয়সেই বিয়ে দেন শান্তি বেগমকে। বিয়ের পরও দারিদ্র্য তার পিছু ছাড়েনি। বর্তমানে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের নারী উপকারভোগী সদস্যের মধ্যে অন্যতম এই নারী। জামালপুর চিনাডুলী ইউনিয়নে খামারিয়া পাড়ায় তার বাড়ি। বদলেছে তার দিন, জীবনমান। সংসারে ফিরেছে শান্তি। বিভিন্ন দেশি জাতের ভেড়া পালন করে তিনি এখন স্বাবলম্বী। প্রাথমিক অবস্থায় ১০ হাজার টাকা ঋণ পেয়ে খামার শুরু করেন শান্তি। দুই বছরের মধ্যে ১০টি ভেড়া বিক্রি করার পরও তার খামারে বাচ্চাসহ ভেড়ার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮টি। ভেড়াপালনে শান্তির সফলতা দেখে এলাকার মানুষ তার দেখানো পথ অনুকরণ করে সক্ষম হয়ে উঠছে। আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট অনেকের কাছ থেকে জানা যায়, খামারিয়া পাড়া নদীভাঙন-কবলিত এবং হতদরিদ্র মানুষ উঠান বৈঠক করে গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠনের মাধ্যমে নিজেদের সঞ্চিত অর্থ থেকে ঋণ গ্রহণ করে বিভিন্ন আয়মূলক কাজে বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের ভাগ্য খুলেছে। সমিতির সদস্যদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করে হতদরিদ্র ও নি¤œ আয়ের মানুষদের কর্মমুখী, উৎপাদনমুখী ও আয়বর্ধক কাজে দক্ষতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে আত্মকর্মশীল হওয়ার বিষয়ে দক্ষ করে তোলা হয়। বর্তমানে খামারিয়া পাড়ার প্রত্যেকে সবজি চাষ, পুকুরের মাছ চাষ এবং হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল ও ভেড়া পালন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। কাকতালীয়ভাবে খামারিয়া পাড়া আজ যেন প্রকৃতপক্ষেই খামার পাড়ায় পরিণত হয়েছে। এ চিত্র এখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সর্বত্র বিরাজ করছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের নাম বদলে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় ও অনুশাসন বিবেচনা করে ২০১৯ সালের ২৫ মার্চ নতুন নামকরণের প্রস্তাবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়েছে। সেই থেকে নতুন নামে পরিচিতি পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ১০টি বিশেষ উদ্যোগের শীর্ষে থাকা অন্যতম এই বিশেষ উদ্যোগ ‘শেখ হাসিনার উপহার আমার বাড়ি আমার খামার, বদলাবে দিন তোমার-আমার।’ এ সেøাগানকে সামনে রেখে দারিদ্র্য নির্মূলে উদ্যোগটির যাত্রা শুরু হয়। আজ দেশের মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত সাড়া থাকায় তৃণমূল পর্যায়ে দরিদ্র মানুষের প্রত্যাশা পূরণে দৃশ্যমান প্রতীকে পরিণত হয়েছে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পটি।
আমার বাড়ি আমার খামর প্রকল্পটি সমাজের দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত করেও দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রকল্পটির স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৩ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত তথ্যপ্রযুক্তি মেলায় সাউথ এশিয়া ও এশিয়া প্যাসিফিক ম্যানথান অ্যাওয়ার্ড ২০১৩’ পদকে ভূষিত হয়।
নিজস্ব জমিতে বসবাস করে জীবনের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার আশা থাকে প্রতিটি মানুষের। কিন্তু সমাজে মানুষ নানা সমস্যায় জর্জরিত। কেউ কাজের অভাবে আয় না থাকায় ন্যূনতম মানসম্পন্ন জীবনযাপন করতে পারে না, আবার কেউ পুঁজির অভাবে চাষাবাদসহ কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন উৎপাদনমূলক কাজে বিনিয়োগ করতে পারে না। ফলে পরিবারের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ তো হয়ই না, এমনকি নিয়মিত খাবারের সংস্থান করতে হিমশিম খেতে হয়। এ সুযোগে স্বার্থান্বেষী অনেক এনজিও সহযোগিতার নামে সাধারণ মানুষদের ঋণের ফাঁদে ফেলে। এতে দরিদ্র মানুষগুলো আরও দরিদ্র এবং ভূমিহীনরা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। এসব দরিদ্র মানুষকে আত্মনির্ভরশীলভাবে সক্ষম করে দারিদ্র্য নিরসন ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে চাষাবাদে পুঁজি বিনিয়োগসহ অন্যান্য আয় বৃদ্ধি করে তাদের মধ্যে আত্মকর্মসংস্থান ও জীবিকায়নের সমৃদ্ধি ঘটানোই ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য।
এ প্রকল্পের তৃতীয় সংশোধনীতে সারা দেশে প্রত্যেক উপজেলায় গঠন করা হয় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সদস্যরা যাতে দুশ্চিন্তায় না পড়েন, সেজন্যই পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক গঠন করা হয়েছে। এই প্রকল্পে যে তহবিল গঠিত হয়েছে তা রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য এবং সদস্যদের স্থায়ী লেনদেন করার জন্যই এ ব্যাংক। এছাড়া প্রত্যেক সদস্য পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক থেকে বছরে ১০০ টাকা মূল্যমানের সর্বোচ্চ ছয়টি শেয়ার ক্রয় করতে পারবেন; নিজস্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক ব্যাংকের অর্জিত লাভ অনুসারে যেকোনো সময় লভ্যাংশ উত্তোলন করতে পারবেন। এ ব্যাংকের ৪৯ শতাংশের মালিক প্রকল্পের আওতায় গঠিত সমিতি এবং ৫১ শতাংশের মালিক সরকার।
গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ দু’বেলা দু’মুঠো খাবার আর পরিবার নিয়ে শান্তিতে থাকতে চায়। মাছ চাষ, গবাদিপশু পালন, বাড়ির অঙিনায় শাকসবজির আবাদ করে একজন কৃষক যখন নিজের যাবতীয় প্রয়োজন মিটিয়ে কিছু আয়ের পথ দেখেন, তখন তিনি নিজের উদ্যোগেই কাজে আত্মনিয়োগ করেন। প্রয়োজন হয় তাকে শুধু পথ দেখানো।
সরকার ‘রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প গ্রহণ করে। সারা দেশে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। সহযোগী হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, সমবায় অধিদপ্তর, বার্ড-কুমিল্লা, আরডিএ বগুড়া এবং ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণাধীনে এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে। আর এ প্রকল্পের সমন্বয় করছেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক।
‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পটি স্থায়ী দারিদ্র্যবিমোচনে ক্ষুদ্র সঞ্চয় মডেল। জাতিসংঘের ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে অভীষ্ট-১ ‘সর্বত্র সব ধরনের দারিদ্র্যের অবসান’ এবং অভীষ্ট-২ ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন ও অভীষ্ট-৫ নারী-পুরুষের সমতা বিধান, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং টেকসই কৃষির প্রসার অর্জনের লক্ষ্যে সমন্বিতভাবে প্রকল্পটি অগ্রাধিকারভিত্তিতে সারা দেশে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
বর্তমানে দেশের আট বিভাগের ৬৪টি জেলায় এবং ৪৯০টি উপজেলায় চার হাজার ৫৫০টি ইউনিয়নের ৪০ হাজার ৯৫০টি ওয়ার্ডে এ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় ১৮ মার্চ ২০২০ সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের ওয়েবসাইট দেওয়া তথ্য অনুসারে সারা দেশে সমিতি গঠন করা হয়েছে এক লাখ ১৬ হাজার ৫২৭টি, উপকারভোগী সদস্য পরিবার ৫০ লাখ ৯৮ হাজার, সদস্য সঞ্চয় এক হাজার ৮৫৯ে কাটি ৬৯ লাখ টাকা, সরকার প্রদত্ত বোনাস এক হাজার ৬১২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, ঘূর্ণায়মান তহবিল দুই হাজার ৭৭৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, মোট ঋণ গ্রহণকারী উপকারভোগীর সংখ্যা ৪০ লাখ ৮৩ হাজার জন, মোট ঋণ বিতরণ ৯ হাজার ৮২৬ কোটি ১০ লাখ টাকা, প্রকৃত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয়বর্ধক খামারের সংখ্যা ২৩ লাখ ৫৭ হাজার, মোট তহবিল ছয় হাজার ৪৮৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। প্রায় আড়াই কোটির অধিক দরিদ্র মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপকৃত হয়েছে এ প্রকল্পের মাধ্যমে।
এ প্রকল্পের কার্যক্রমে এমনভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে, যাতে দরিদ্র মানুষগুলো নিজেই তার প্রয়োজনকে তুলে ধরতে পারে। দরিদ্র কৃষক নিজস্ব সক্ষমতা যাচাই করে তার চাহিদা অনুযায়ী এবং পছন্দমাফিক কৃষিভিত্তিক যে-কেনো কাজে অর্থ বিনিয়োগ করতে পারবে। প্রথমত, দরিদ্র ও অনুন্নত পরিবারকে বাছাই করে ৬০টি ক্ষুদ্র কৃষি পরিবারের সমন্বয়ে সমবায় সমিতি গঠন করা হয়। এসব ৬০টি পরিবারের প্রধান হবেন ৪০ জন মহিলা এবং ২০ জন পুরুষ। স্থানীয় প্রশাসন, সরকারি প্রতিনিধি ও জনগণের মাধ্যমে গ্রামের উম্মুক্ত সভায় দরিদ্র এবং প্রান্তিক কৃষি পরিবার নির্বাচন করা হয়। নিজস্ব চাহিদা নিরূপণ করে সদস্যরা ১০ হাজার থেকে পর্যাক্রমে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত একক এবং যৌথ খামারিরা এক লাখ থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত অনুদানের জন্য আবেদন করতে পারবেন। পর্যালোচনা শেষে প্রজেক্ট অফিস থেকে অনুমোদনপ্রাপ্ত অর্থ কৃষক তার সুবিধাজনক কৃষিভিত্তিক উৎপাদনমূলক কাজে বিনিয়োগ করতে পারবেন।
এ প্রকল্পে ঘূর্ণায়মান তহবিল হিসেবে সরকারের তরফ থেকে দ্বিতীয় ধাপে এক দশমিক ৫০ লাখ টাকা প্রতি বছর গ্রাম উন্নয়ন সংস্থাকে দেওয়া হয়। সদস্যদের নিজস্ব তহবিলে বোনাস হিসেবে আত্মীকরণ হয়ে থাকে। প্রত্যেক গ্রাম উন্নয়ন সংস্থার চেয়ারম্যান ও ম্যানেজারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া সমিতির ৬০ জন সদস্যের পাঁচজনকে পাঁচটা প্রদর্শনী খামার গড়ে তোলার জন্য কৃষি, নার্সারি, মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগির খামার ও গবাদি পশুপালন এ পাঁচটি ক্ষেত্রে দক্ষতা উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তারই ভিত্তিতে অন্য সদস্যরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা অর্জনে সক্ষম হয়ে উঠবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজন্ম লালিত স্বপ্ন সোনার বাংলা গড়ার যে প্রত্যয়, তা বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নানা পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আজ মাথাপিছু আয় এক হাজার ৯০৯ মার্কিন ডলার। মানুষের গড় আয়ুষ্কাল ৭৩ বছর। সরকার দারিদ্র্যকে প্রধান শত্রু হিসেবে আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে। এখন আমাদের উচিত যার যতটুকু সম্পদ রয়েছে তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। ভিশন-২০৪১ ও দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২০-২০৪১) বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নিশ্চয় প্রতিষ্ঠিত হবে আমাদের সোনার বাংলা মুজিব শতবর্ষে সে প্রত্যাশা হোক আমাদের সবার।
পিআইডি নিবন্ধ