Print Date & Time : 29 August 2025 Friday 1:36 am

তেল-গ্যাস অনুসন্ধান: দরপত্র ছাড়াই ইজারা দেওয়া হচ্ছে সমুদ্রের ১২ নং ব্লক

নিজস্ব প্রতিবেদক: গভীর সমুদ্রের ১২ নম্বর ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ পাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি দাইয়ু ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন। দরপত্র ছাড়াই দেওয়া হচ্ছে এ কাজ। আগামীকাল মঙ্গলবার পেট্রোবাংলার সঙ্গে এ-সংক্রান্ত চূড়ান্ত চুক্তি সই করবে কোম্পানিটি। দরপত্র ছাড়া এ চুক্তি সইয়ে অনুসরণ করা হচ্ছে দ্রুত জ্বালানি সরবরাহ আইন (বিশেষ আইন) ২০১০। ফলে কোনো ধরনের জবাবদিহিতা করতে হবে না সংশ্লিষ্টদের।

পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, গভীর সমুদ্রের ১২নং ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য প্রাথমিক চুক্তি করা হয় গত বছর ডিসেম্বরে। সময়ক্ষেপণের অজুহাতে এক্ষেত্রে দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। অযাচিত (আনসলিসেটেড) প্রস্তাব হিসেবে গ্রহণ করা হয় দাইয়ু ইন্টারন্যাশনালের প্রস্তাব। পরে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ভিত্তিতে সমঝোতা চূড়ান্ত করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিন হাজার ৫৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ গ্যাস ব্লকের ইজারা দেওয়ার চূড়ান্ত চুক্তিটি পাঠানো হয় আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের জন্য। এবার চূড়ান্ত চুক্তি সই করা হচ্ছে। রাজধানীর পেট্রো সেন্টারে এ চুক্তি সই হবে।

ব্লকটিতে প্রথম দুই বছর দ্বিমাত্রিক জরিপ চালাবে দাইয়ু। গ্যাসের প্রাপ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর ত্রিমাত্রিক জরিপ চালানো হবে। আর গ্যাস উত্তোলনের পর তা সাড়ে ৬ ডলারে কেনা হবে আশা করছে দাইয়ু।

পেট্রোবাংলা আশা করছে, চুক্তি সম্পাদিত হলে চলতি বছরের মধ্যে ব্লকটিতে জরিপ শুরু করা যাবে। আর ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ জরিপের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে তেল-গ্যাসের প্রাপ্যতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।

এ প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহ শেয়ার বিজকে বলেন, গভীর সমুদ্রের ১২নং ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ুর সঙ্গে চুক্তি করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আগেই আলোচনা চূড়ান্ত করা হয়। এর পর প্রাথমিক চুক্তি সই করা হয়েছিল। এবার চূড়ান্ত চুক্তি সই করা হবে। আশা করা যায় আগামী বছরের মধ্যে ব্লকটিতে গ্যাসের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে অগভীর সমুদ্রে ৯টি ও গভীর সমুদ্রে ৩টি ব্লকের জন্য দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। এ দরপত্রে ৪ ব্লকে ৩টি দরপত্র জমা পড়ে। অগভীর সমুদ্রে ৪ ও ৯ নম্বর ব্লকে ভারতীয় দুই কোম্পানি ওএনজিসি বিদেশ লিমিটেড (ওভিএল) ও অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেডের (ওআইএল), ব্লক ৭-এ কনোকো ফিলিপস এবং ব্লক ১১-তে সান্তোস-ক্রিস এনার্জি দর প্রস্তাব জমা দেয়। এর মধ্যে সান্তোস-ক্রিস এনার্জির সঙ্গে ২০১৪ সালের মার্চে চুক্তি হয়। ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে চুক্তি হয়েছে। তবে কনোকো ফিলিপস ৭নং ব্লকটি ছেড়ে দিয়েছে।

২০১৩ সালের ডিসেম্বরে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আরেকটি আগ্রহপত্র (ইওআই) আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। এতে ১২, ১৬ ও ২১ নং এই তিন ব্লকের জন্য যৌথভাবে একমাত্র দর প্রস্তাব জমা দিয়েছিল কনোকো ফিলিপস ও স্টেট ওয়েল। তবে সেখান থেকেও কনোকো নিজেকে সরিয়ে নেয়। ফলে সেটিও আর অগ্রসর হয়নি।

এর পর বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য গত বছর ৫ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে অযাচিত প্রস্তাব আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। এতে নরওয়ে-ভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি স্টেট অয়েল, সিঙ্গাপুরভিত্তিক ক্রিস এনার্জি ও দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক দাইয়ু গভীর সমুদ্রের ১২, ১৬ ও ২১ নম্ব^র ব্লকে অনুসন্ধান করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে। এরপর পেট্রোবাংলা তাদের প্রস্তাব জমা দিতে বলে।

প্রথমে স্টেট অয়েল কয়েক দফায় যোগাযোগের পর প্রস্তাব জমা দেওয়ার জন্য সময় চায়। আগ্রহপত্র জমা দিলেও উৎপাদিত গ্যাসের মূল্য নিয়ে সমঝোতা না হওয়ায় পিছু হটে স্টেট অয়েল। এরপর দাইয়ু আগ্রহপত্র জমা দেয়। তবে শুধু ১২নং ব্লকের জন্য দাইয়ু প্রস্তাব জমা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে কোরিয়ান কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা শুরু করে পেট্রোবাংলা। পেট্রোবাংলা ও দাইয়ুর মধ্যে আলোচনায় একমত হওয়ায় গত ৯ অক্টোবর দাইয়ুর সঙ্গে প্রাথমিক চুক্তি অনুস্বাক্ষর অনুমোদন করে মন্ত্রণালয়। পরে ডিসেম্বরে প্রাথমিক চুক্তি সই করা হয়। আর এবার চূড়ান্ত চুক্তি করা হচ্ছে। বিশেষ আইনের আওতায় প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা জানান, তেল-গ্যাস অনুসন্ধান একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। দর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তেলে-গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রম শুরু করতেই ৩-৪ বছর লেগে যায়। এরপর অনুসন্ধান কার্যক্রম চলে আরও কয়েক বছর। কিন্তু দেশে জ্বালানি সঙ্কট দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার দ্রুত তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করতে চাইছে। তাই সমঝোতার মাধ্যমে উপযুক্ত কোম্পানিকে গ্যাস ব্লক ইজারা দেওয়া হচ্ছে।

জ্বালানি বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিশেষ আইনে এ সুযোগ (সমঝোতা) রয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে এ আইনের প্রয়োগে সুফলও পাওয়া গেছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. ম. তামিম এ বিষয়ে বলেন, দরপত্র ছাড়াই বিশেষ আইনের আওতায় নিয়োগ প্রক্রিয়া দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে। এর পর সরকারি কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পছন্দের কোম্পানিকেও এ ধরনের কাজ দেয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু হবে। এছাড়া দরপত্রের মাধ্যমে গ্যাস খাতে যেসব চুক্তি হয়েছে তা নিয়েই অনেক সমালোচনা আছে। ফলে দরপত্র ছাড়া কাজ দেওয়াটা হবে আরও ভয়ঙ্কর।

উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে ৭টি উৎপাদন বণ্টন চুক্তির (পিএসসি) আওতায় ৫টি বিদেশি কোম্পানি ৮টি ব্লকে কাজ করছে। এর মধ্যে স্থলভাগের জন্য তিনটি পিএসসি ও সমুদ্রের ব্লকের জন্য ৪টি পিএসসি স্বাক্ষর হয়েছে। স্থলভাগের ১২ (বিবিয়ানা), ১৩ ও ১৪ (জালালাবাদ ও মৌলভীবাজার) ব্লকে যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন এবং ৯ নম্বর (বাংগুরা) ব্লকে তাল্লো ও ক্রিস এনার্জি এবং সমুদ্রের ১৬ নম্বর ব্লকে (মাগনামা) সান্তোস কাজ করছে। আর অগভীর সমুদ্রের ১১ ব্লক সান্তোস ও ক্রিস এনার্জি এবং ৪ ও ৯ নম্বর ব্লক ভারতীয় দুই কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ লিমিটেড (ওভিএল) ও অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড (ওআইএল) ইজারা নিয়েছে।