ঢাকা কাস্টম হাউস

তৈরি করে ‘জাল ইনভয়েস’চায় কোটি টাকা ঘুষ

রহমত রহমান: আমদানি করা পণ্যের শুল্কায়ন শেষ। শুল্ককর পরিশোধের পরদিন খালাস পর্যায়ে ব্যবসায়ী জানতে পারেন বিল অব এন্ট্রি লক করা হয়েছে। ব্যবসায়ীকে জানানো হয় হাউসের ‘রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট’ থেকে লক করা হয়েছে। অথচ রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিশনারেট লক বিষয়ে কিছুই জানে না। ব্যবসায়ীকে হয়রানি করতে রাতারাতি তৈরি করা হয় ‘জাল ইনভয়েস’। পণ্য এসেছে ‘টার্কিশ এয়ারলাইনসে’, জাল ইনভয়েস তৈরি করা হয় ‘কাতার এয়ারওয়েজের’ নামে। সেই জাল ইনভয়েস সমাধানে ‘কোটি টাকা ঘুষ’। যদিও আমদানি করা পণ্যের মোট দাম প্রায় ৭৮ লাখ টাকা। ঘুষের কোটি টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় এক কোটি ৩৮ লাখ টাকা শুল্ককর ফাঁকির মামলা দেয়া হয়। ব্যবসায়ী আর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের বিন লক করা হয়। জাল ইনভয়েস নিয়ে ব্যবসায়ী থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। ঢাকা কাস্টম হাউসে ‘কমিশনার’ আর এক ‘সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার’ পরস্পর যোগসাজশে এভাবে এক ব্যবসায়ীকে হয়রানির অভিযোগ উঠেছে।

ঘুষ চাওয়া ও হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে হাউসে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই তদন্তে বেরিয়ে আসে যে ভুয়া ইনভয়েস তৈরি করা হয়েছে। হয়রানির নায়ক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শিবলী মাহফুজ হিমেল। আর তাকে সরাসরি ইন্ধন দিয়েছেন কমিশনার একেএম নুরুল হুদা আজাদ। হয়রানির শিকার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ জাহিদুল হক এনবিআরে হয়রানির লিখিত অভিযোগ করেছেন। এনবিআর এই নিয়ে কাজ শুরু করেছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। অভিযোগ ও হয়রানি-সংক্রান্ত সব দলিলের একটি কপি শেয়ার বিজের হাতে রয়েছে। অন্যদিকে হয়রানির সঠিক বিচার পেতে উচ্চ আদালতে রিট করেছেন ওই ব্যবসায়ী।

অভিযোগে বলা হয়, রাজধানীর চামেলীবাগ শান্তিনগর এলাকার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বায়োজিন। প্রতিষ্ঠানটি পোল্যান্ড থেকে প্রসাধন সামগ্রী আমদানির জন্য ১২ জুন এলসি খোলে; এলসি মূল্য ২৫০৮.৮০ ইউরো। ১৪ আগস্ট টার্কিশ এয়ারলাইনসে পোল্যান্ড থেকে ‘হোয়াইট হোইটেনিং ফেসওয়াশ জেল’ ঢাকা কাস্টম হাউসে আসে। ২২ আগস্ট পণ্য ছাড় করতে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এন আহমেদ অ্যান্ড কোং লিমিটেডের মাধ্যমে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করা হয়। শুল্কায়ন শেষে ৩১ আগস্ট ২৩ লাখ ৯২ হাজার ৭৯০ টাকা শুল্ককর জমা দেয় প্রতিষ্ঠান। ১ সেপ্টেম্বর পণ্য খালাসের কথা ছিল। খালাস করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠান জানতে পারে ওই দিন দুপুরে ‘রিস্ক ম্যানেজমেন্টের’ নামে প্রতিষ্ঠানের বিন ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের এআইএন লক করা হয়েছে।

এনবিআর সূত্রমতে, কাস্টমস রিস্ক ম্যানেজমেন্ট নামে নতুন কমিশনারেট কার্যক্রম শুরু করেছে। এই কমিশনারেট সৃষ্টির আগে সব কাস্টম হাউস ও স্টেশনের আওতায় রিস্ক ম্যানেজমেন্টের কাজ শুরু হয়। নতুন কমিশনারেট হওয়ার পরও বিভিন্ন কাস্টম হাউসে ব্যবসায়ীদের বিন লক করে হয়রানির অভিযোগ পাওয়া যায়। বিশেষ করে ঢাকা কাস্টম হাউসে দুই ব্যবসায়ীর বিন লক করে হয়রানি করার অভিযোগ ওঠে। গোপনে যাচাই করে সত্যতা পায় কমিশনারেট। ঢাকা কাস্টম হাউসে রিস্ক ম্যানেজমেন্টের একটি কক্ষ ছিল, যেখানে দুই কর্মকর্তা বসতেন, যার মধ্যে একজন হিমেল। রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিশনারেটের তৎপরতার পর কক্ষ থেকে সাইন বোর্ড সরিয়ে নেয়া হয়েছে। রিস্ক ম্যানেজমেন্টের নামে বায়োজিনের বিন লক করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কমিশনারেট কিছুই জানে না।

অভিযোগে আরও বলা হয়, ওই ব্যবসায়ী রিস্ক ম্যানেজমেন্টে গিয়ে হিমেলকে বিন লক করার বিষয়ে জানতে চান। হিমেল একটি বেগুনি রঙের প্রিন্ট করা ইনভয়েস দেখান, যাতে পণ্যের দাম লেখা ৮৮৭৪১.২৭ ইউরো। সেই ইনভয়েসে সই ও সিল নেই। এই ইনভয়েসের কারণে পণ্যগুলো জব্দ করা হয়েছে বলে জানান হিমেল। অথচ ব্যবসায়ীর অরজিনাল ইনভয়েসে পণ্যের মূল্য ছিল ২৫০৮.৮০ ইউরো। অরজিনাল ইনভয়েসে ক্রেতা-বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের নাম, দেশ, পণ্যের নাম ও পণ্যমূল্য বিস্তারিত লেখা থাকলেও প্রিন্ট করা সেই ইনভয়েসে তা নেই। পণ্যগুলো ভুয়া ইনভয়েস মূল্যে খালাস নিতে হবে, না হয় এক কোটি টাকা ঘুষ দিতে হবে বলে জানান হিমেল। প্রতিবাদ জানালে হুমকি দেয়া হয়। জাল ইনভয়েসের বিষয়ে ব্যবসায়ী বিমানবন্দর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন।

আরও বলা হয়, ঘুষ না দেয়ায় জাল ইনভয়েস দিয়ে শুল্ক ফাঁকির চেষ্টার কথা উল্লেখ করে ৩১ আগস্ট মামলা করা হয়। মামলায় বলা হয়, বায়োজিন ৮৮৭৪১.২৭ ইউরোর পণ্য ২৫০৮.৮০ ইউরো ঘোষণা দিয়ে পণ্য খালাস নিয়ে এক কোটি ৩৮ লাখ ১১ হাজার ৮৭৩ টাকা শুল্ককর ফাঁকি দেয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে। মামলায় ভুয়া সেই ইনভয়েসকে কাতার এয়ারওয়েজ থেকে নেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। অথচ ব্যবসায়ীর অরিজিনাল ইনভয়েসে টার্কিশ এয়ারলাইনসের মাধ্যমে পণ্য আমদানি করার কথা উল্লেখ রয়েছে। জাল ইনভয়েস, ঘুষ দাবি ও মামলার বিষয় জানাতে ব্যবসায়ী কমিশনারের সঙ্গে দেখান করেন। কমিশনার কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো হিমেলের প্রস্তাব মেনে নিতে ব্যবসায়ীকে পরামর্শ দেন। মামলায় দাবিনামা জারি করা হয়। কমিশনার আজাদ ও হিমেল পরস্পর আত্মীয়। দুজনের যোগসাজশে বেশ কিছু ব্যবসায়ী ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে হয়রানি করা হয়েছে, করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্য।

২৭ সেপ্টেম্বর আবার কমিশনারের কাছে আবেদন করেন ব্যবসায়ী। প্রতিকার না পেয়ে ৪ অক্টোবর এবং ১০ অক্টোবর এনবিআর চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন ওই ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীর তৎপরতা দেখে বিষয়টি মীমাংসা করার চেষ্টা করেন হিমেল ও কমিশনার। ব্যবসায়ী রাজি না হওয়ায় বিষয়টি তদন্তে তিন কর্মকর্তার সমন্বয়ে কমিটি করেন কমিশনার। কমিটি আমদানি-সংক্রান্ত দলিলাদি যাচাই ও অনুসন্ধান করে ১৯ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়োজিনের বিল অব এন্ট্রি, ব্যাংক এলসির সঙ্গে দাখিল করা ইনভয়েসের মিল পাওয়া গেছে। তবে বিতর্কিত ইনভয়েসের সঠিকতা যাচাইয়ে বাংলাদেশস্থ পোল্যান্ড দূতাবাসে চিঠি দেয়া হয়। দূতাবাস যাচাই শেষে ১৫ সেপ্টেম্বর জানিয়ে দেয়, ৮৮৭৪১.২৭ ইউরোর ইনভয়েসটি জাল। কমিটি ব্যাংক গ্যারান্টিতে পণ্য ছাড়ের সুপারিশ করে। পরে ব্যবসায়ী আর্থিক ক্ষতি এড়াতে ব্যাংক গ্যারান্টিতে পণ্য খালাস করেন।

অভিযোগে বলা হয়, প্রতিবেদনে জাল ইনভয়েস তৈরি করে হয়রানির বিষয়টি স্পষ্ট হলেও মামলা ও দাবিনামা প্রত্যাহার করেনি কাস্টম হাউস। বিনও আনলক করা হয়নি। উল্টো ব্যবসায়ীকে ‘দেখে’ নেয়ার হুমকি দেয়া হয়। পরে ব্যবসায়ী উকিল নোটিশ পাঠালে বিন আনলক করা হয়। তবে আবার বিন লক করার হুমকি দেয়া হচ্ছে। ব্যবসায়ী কমিশনার ও হিমেলের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করেন।

সূত্রমতে, হয়রানির প্রতিকার না হওয়ায় ব্যবসায়ী ১৩ নভেম্বর হাইকোর্টে রিট করেন। আদালত ২১ নভেম্বর শুনানি শেষে কমিশনার একেএম নুরুল হুদা আজাদ ও শিবলী মাহফুজ হিমেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ৩০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেয়। রিটে জাতীয় এনবিআর চেয়ারম্যান, অর্থ সচিব, কমিশনার ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা হিমেলকে (যিনি বর্তমানে সিলেটে কর্মরত) বিবাদী করা হয়।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী বায়োজিনের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ জাহিদুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, একজন কমিশনারের ডকুমেন্ট জালিয়াতি করে হয়রানি করা খুবই দুঃখজনক। আমি সু®ু¤ তদন্তের মাধ্যমে এর বিচার চাই। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে কমিশনার একেএম নুরুল হুদা আজাদের ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করেন হিমেল। তিনি বলেন, কাস্টম হাউসে কোনো গোপন সংবাদ এলে ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করা হয়। আমরাও কাজ করেছি। তবে কাউকে হয়রানি করা হয়নি। আমি তো সেখান থেকে বদলি হয়ে চলে এসেছি। এই বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। সেজন্য আমি কিছু বলব না। ভুয়া ইনভয়েস তৈরির বিষয় অস্বীকার করেন তিনি।