আনন্দ উপাদান সংযোজনের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে গেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বর্তমানে শিক্ষাদানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নানা চিত্র জুড়ে দেওয়া হচ্ছে পাঠ্যপুস্তকে। এসবের বাইরে কিছুটা ভিন্নতা নিয়ে প্রতিষ্ঠানের ভবনে ইতিহাসনির্ভর পাঠ-সংক্রান্ত চিত্র তুলে ধরে দেয়াল সাজিয়ে শিশু শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বলছি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা।
স্বাধীনতার ইতিহাস, সাত বীরশ্রেষ্ঠ, ভাষাশহীদদের তালিকা, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের খণ্ডচিত্রসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে সাজানো হয়েছে বিদ্যালয় ভবনের সামনে ও পেছনের দেয়ালগুলো। শহীদ মিনার, মিডডে মিল বাস্তবায়ন, শিশুদের নির্দিষ্ট ডাস্টবিন ব্যবহার, রাস্তায় চলাচলে ট্রাফিক নিয়মের আইন-কানুন, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ, শিশুবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে তৈরির জন্য সরঞ্জামাদি দিয়ে সাজানো হয়েছে ত্রিশালের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো।
শিশুদের লেখাপড়ায় মনোযোগ বাড়াতে প্রয়োজন শিশুবান্ধব পরিবেশ। সে বিষয়টি মাথায় রেখেই মূলত এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখানের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুনত্বকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
স্কুলের সব দেয়াল ও আঙিনা যেন শিক্ষার একেকটি রঙিন ক্যানভাস। ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের শতভাগ স্কুলগামী করা ও মানসম্মত পাঠদান নিশ্চিতকরণে বাস্তবমুখী শিক্ষা দিয়ে প্রাথমিক স্তরের শিশুদের গড়ে তুলতে ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগ নিয়েছেন ত্রিশাল উপজেলা শিক্ষা অফিসার নূর মোহাম্মদ।
উপজেলার সব স্কুলকে তিনি রাঙিয়ে তুলছেন লাল-সবুজের রঙে। শিশুদের নজর কাড়তে দেয়ালে আঁকা হয়েছে নানা ধরনের ছবি। জাতীয় পতাকা, বঙ্গবন্ধু, বীরশ্রেষ্ঠ, ভাষাশহীদ, বর্ণমালা, স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, ছয় ঋতুসহ নানা ধরনের চিত্রে বিদ্যালয়ের প্রতিটি দেয়াল যেন শিক্ষার একেকটি রঙিন ক্যানভাস। বাদ পড়েনি বিদ্যালয়গুলোর সদ্য নির্মিত সীমানা প্রাচীরগুলোও। সেখানেও আঁকা হয়েছে মনীষীদের বাণী, ফুল, ফল, পাখি, মিনা-রাজুর ছবি প্রভৃতি।
বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার মাঝে চোখে পড়া এসব চিত্র শিশুমনে জোগায় ভাবনার খোরাক। এছাড়া মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার ক্লাস যোগ করেছে নতুন মাত্রা।
শিক্ষকরা বলছেন, এ কার্যক্রমের ফলে ক্লাসে শিক্ষার্থীর উপস্থিতির হার বাড়ছে। শিক্ষার্থীর পাশাপাশি অভিভাবকদেরও মুগ্ধ করেছে রঙের ছোঁয়ায় রাঙানো বিদ্যালয়গুলো। উপজেলা শিক্ষা অফিস জানিয়েছে, এরই মধ্যে উপজেলার ১০২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘লাল-সবুজের ক্যানভাস’ তৈরি সম্পন্ন হয়েছে। আরও ৮০ বিদ্যালয়ে ‘লাল-সবুজের ক্যানভাস’ তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। বাহারি শিশুবান্ধব এমন আয়োজনে শুধু বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই নয়, উচ্ছ্বসিত অভিভাবকরাও। ভিন্নধর্মী এমন উদ্যোগের ফলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়মুখী হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। অভিভাবকরাও নিয়মিত শিক্ষার্থীর খোঁজ নিচ্ছেন। শাহানাজ বেগমসহ কয়েকজন অভিভাবক জানান, শিশুরা আগের তুলনায় অনেক বদলে গেছে। যে শিশুটি কিছুদিন আগেও স্কুলে আসতে চাইত না, সে এখন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন খাবার নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে আসছে। তারা বলেন, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার এমন উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের স্কুলে আসার আগ্রহ দেখে আমরা চিন্তামুক্ত।
বইলর কানহর বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা ফারহানা জামান বলেন, এ ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়নের ফলে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়মুখী হচ্ছে, দ্বিগুণ হারে বেড়ে গেছে উপস্থিতি। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকরাও উচ্ছ্বসিত। কিন্ডারগার্টেন থেকে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেছেন। কোনাবাড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা রিনা মুজাফফর বলেন, উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ায় শিক্ষার্থীরা আনন্দের সঙ্গে পড়ালেখা করছে।
সহকারী শিক্ষা অফিসার (ধানিখোলা ক্লাস্টার) জহির আলম বলেন, একটু সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে শিশুদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব। শিক্ষার্থীরা এখন ছুটির পর স্কুল ছেড়ে যেতে চায় না। স্কুল খোলার নির্ধারিত সময়ের আগেই চলে আসে। শিক্ষার্থীরা দেখে শেখে ৮৩ শতাংশ। তাইতো তাদের দেয়ালগুলোকে বানিয়ে দেওয়া হয়েছে লাল-সবুজের ক্যানভাস। ইতিহাস, ঐতিহ্য, পাঠ্যবইয়ের অংশ সবই আছে তাদের স্বপ্নের ক্যানভাসে।
সরকারি হিসাবমতে, দেশের অন্য স্থানের তুলনায় ত্রিশালের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর হার সবচেয়ে বেশি। তাই উপজেলার মোট ১৮২ স্কুলে শুরু হয়েছে এমন কার্যক্রম, যা পরবর্তী সময়ে দেশজুড়ে সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চালু করা হবে বলে মনে করেন ‘লাল-সবুজের ক্যানভাস’-এর উদ্ভাবক ত্রিশাল উপজেলা শিক্ষা অফিসার নূর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ত্রিশালে অনেক শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠায় শিশুশ্রম বেশি। তাই বাড়ছে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এমন বাস্তবতার নিরিখে তাদের স্কুলমুখী করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিক্ষক, অভিভাবক ও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় ‘লাল-সবুজের ক্যানভাস’ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। তিনি আরও বলেন, আমি এখানে যোগ দেওয়ার পর শতভাগ বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ, মিডডে মিল বাস্তবায়ন, শতভাগ শিশুকে স্কুলগামী করতে অভিভাবক সমাবেশ, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার, শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বৃদ্ধির নির্দিষ্ট ডাস্টবিন তৈরি, রাস্তা চলাচলে নিয়ম মানার নির্দেশিকা শিক্ষা দেওয়া ও লাল-সবুজের রঙে সব বিদ্যালয়কে সাজিয়েছি। যা স্কুলগামী শিক্ষার্থী ও শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রভাব ফেলেছে নিঃসন্দেহে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল জাকির বলেন, উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নত করতে এ ধরনের ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোফাজ্জল হোসেন বলেন, বর্তমান সরকারের প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়ে এ ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
এম. ইদ্রিছ আলী, ময়মনসিংহ