কাজী তামান্না ইসলাম: বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঘনবসতির স্বল্প আয়তনের, প্রাকৃতিক সম্পদের অভাবের এই দেশে প্রধান সম্পদ মানুষ। মানবসম্পদ উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা। বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন পরিস্থিতি মধ্যম সারির। সার্বিকভাবে মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। সারা বিশ্বের মানব উন্নয়ন পরিস্থিতি সবচেয়ে ভালো নরওয়েতে, এরপর আছে যথাক্রমে আয়ারল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ড। বাংলাদেশে আয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মানব উন্নয়নের এই তিনটি সূচকই করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানুষের আয় ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার হলেও শিক্ষা খাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। সামাজিক খাতে উন্নয়ন সত্ত্বেও বাংলাদেশে আয়-বৈষম্য প্রকট। আয়-বৈষম্য সত্ত্বেও বাংলাদেশ স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতে ভালো করছে। যেমন গড় আয়ুর হিসেবে ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৬ বছর, ভারতের গড় আয়ু ৬৯ দশমিক ৭ বছর। বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ জীবিত শিশু জন্মগ্রহণকালে ১৭৩ জন মা মারা যান। বাংলাদেশের ২৫ বছর ও এর বেশি বয়সী নারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৩৯ দশমিক ৮ শতাংশ কমপক্ষে মাধ্যমিক পাস। আর পুরুষদের মধ্যে এই হার ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ। শ্রম শক্তিতেও নারীর অংশগ্রহণ বেড়ে ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ খুব তাড়াতাড়ি অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। একজন সুস্থ কর্মী স্বাস্থ্যহীন বা রোগা কর্মীদের চেয়ে বেশি উৎপাদনশীল বলে স্বাস্থ্য খাতে খরচকে শিক্ষা খাতের চেয়ে প্রত্যক্ষ অবদানকারী হিসেবে দেখা হয়। তাই মানবসম্পদ উন্নয়নের বিচারে স্বাস্থ্যের শিক্ষার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন যুবসমাজের আইকন। তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যুবরাই জাতির প্রাণশক্তি, উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রধান নিয়ামক। শুধু তাই নয়, যুবরা সাহসী, বেগবান, প্রতিশ্রুতিশীল, সম্ভাবনাময় এবং সৃজনশীল। এরই ধারাবাহিকতায় যুবসমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করার লক্ষ্যে তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন কারিগরি, বৃত্তিমূলক এবং কৃষিভিত্তিক বহুমুখী প্রশিক্ষণ প্রদান করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত আধুনিক ও উন্নত বাংলাদেশে পরিণত করার লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে সমায়াবদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন শুরু করেছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজন বিদ্যমান জনশক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা। ক্রমবর্ধমান শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বহুমুখী শ্রমের চাহিদা পূরণ করা, প্রযুক্তির পরিবর্তনে কর্ম-সংকোচনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীদের পুনঃপ্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মোপযোগী করা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক সংখ্যক দক্ষ জনবলের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা।
কভিড-১৯-এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে দক্ষ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে বর্তমান সরকার এরই মধ্যে নানা রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ, ২০১৬-১৭ অনুযায়ী দেশে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম শ্রমশক্তি ৬ কোটি ৩৫ লাখ। এই বিপুল কর্মক্ষম জনসম্পদকে কাজে লাগিয়ে উন্নত দেশ গঠনে সরকার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এ প্রেক্ষাপটে সরকার বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নের মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়নে কাজ করছে। ফলে মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে। হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০২০-এ মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩৩তম। দক্ষিণ এশিয়ায় মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের ওপরে আছে শ্রীলংকা (৭২), মালদ্বীপ (৯৫), ভুটান (১২৯) ও ভারত (১৩১)। এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ দুই ধাপ এগিয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান এবার দুই ধাপ করে পিছিয়েছে। জনসংখ্যার তুলনায় চিকিৎসকের অনুপাতে বাংলাদেশের চেয়ে ভারত এগিয়ে আছে। ভারতে প্রতি ১০ হাজার নাগরিকের জন্য গড়ে ৮ দশমিক ৬ জন চিকিৎসক আছে। বাংলাদেশে এই সংখ্যা ৫ দশমিক ৮।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক খাতে ২০২১-২২ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ২৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ২৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এ অর্থ মানবসম্পদ উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত খাত সমূহ যেমনÑশিক্ষা ও প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, নারী ও শিশু, সমাজকল্যাণ, যুব ও ক্রীড়া উন্নয়ন, সংস্কৃতি, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রভৃতি খাতে ব্যয় করা হচ্ছে এবং হবে। মানবসম্পদ উন্নয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। তাই এ দুই খাতকে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে সরকার প্রতি বছর পর্যপ্ত অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ দুই খাতের মোট বরাদ্দ ১ লাখ ৪ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এর ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাস্তবসম্মত কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হবে।
কভিড-১৯ অভিঘাতের ক্রান্তিকাল কাটিয়ে উঠে শিক্ষার উন্নয়নকে আরও বেগবান করার লক্ষ্যে আধুনিক ও বিজ্ঞানমুখী শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। সরকার ইতোপূর্বে রূপকল্প-২০২১ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুগোপযোগী ও কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যা জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ হিসেবে পরিচিত। এ শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য হলো মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়নে ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলা। এরই ধারাবাহিকতায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা বিশেষত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে বিবেচনা করে শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষা কার্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তি এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এসব পদক্ষেপের উল্লেখযোগ্য হলো, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে কারিগরি শিক্ষার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ব্লেন্ডেড লার্নিং পদ্ধতিতে প্রথাগত শ্রেণিকক্ষ কার্যক্রমের সঙ্গে প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল মিডিয়াকে একীভূত করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শিখন-শেখানোর অভিজ্ঞতায় নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাধীন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অনলাইনে এন্ট্রিকরণের কাজ চলমান রয়েছে। মাঠ পর্যায়ের দপ্তর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম (ডিএমএস) অ্যাপের মাধ্যমে পরিদর্শন করা হচ্ছে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রস্তুতি হিসেবে কারিগরি শিক্ষাকে মূলধারার অন্তর্ভুক্তকরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে সাধারণ ধারার ৬৪০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জানুয়ারি ২০২০ সাল থেকে ভোকেশনাল কোর্স পরিচালনা করছে। পর্যায়ক্রমে মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারের ভোকেশনাল কোর্স পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার উপযোগী দক্ষ জনবল সৃষ্টির লক্ষ্যে মান সম্পন্ন কারিগরি শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ করা হয়েছে। যেমনÑঅধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীর ভর্তির সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে অবকাঠামো উন্নয়ন, ৪৯ পলিটেকনিক ও ৬৪টি টিএসসি’র সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন, ইংরেজি ও গণিত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান।
বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি মোট ১০ হাজার ৪৫২টি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাধীন সরকারি প্রতিষ্ঠান ১১৯টি। কারিগরি শিক্ষাক্ষেত্রে গত এক দশকে শিক্ষার্থী ভর্তির হারে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। ২০২০ সঙ্গে কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির হার ছিল ১৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় এনরোলমেন্ট ২৫ শতাংশে উন্নতির লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন শুরু করেছে। ইতোমধ্যে সরকার কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করছে। গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য আর্থিক সহায়তাসহ নানা রকম সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। দেশে দক্ষ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে ১০০ উপজেলায় একটি করে টেকনিক স্কুল ও কলেজ স্থাপন প্রকল্প, চার বিভাগীয় শহরে (সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও রংপুর) ১টি করে মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন, ২৩ জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন এবং চারটি বিভাগে (চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর) একটি করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপনের কাজ চলমান।
আজকের যুবসমাজই জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত-সমৃদ্ধি ও আত্মমর্যাদাশীল সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রধান কারিগর। দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমেই যুবসমাজের কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব। দক্ষতা উন্নয়নের বিষয়ে তাদের সচেতন করা, আধুনিক প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষিত করা এবং কর্মসংস্থানের পথ নির্দেশনা প্রদান করার মাধ্যমে জাতি পাবে উন্নত বাংলাদেশ।
পিআইডি নিবন্ধ