শেয়ার বিজ ডেস্ক: ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’র প্রভাবে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে বৈরী আবহাওয়ায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবার দিনভর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির পর গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে মাঝারি বৃষ্টির সঙ্গে দমকা ও ঝড়ো হাওয়া বইছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে দক্ষিণাঞ্চলের অভ্যন্তরীণ রুটে সব ধরনের যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইব্লিউটিএ)।
গতকাল সকালে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিআইব্লিউটিএ-এর বরিশাল নদীবন্দর কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, নদীবন্দরে এমনিতেই ২ নম্বর সংকেত থাকায় সকালে ৬৫ ফুটের নিচের লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে এখন বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করায় আগাম সতর্কতা হিসেবে অভ্যন্তরীণ রুটে লঞ্চসহ সব ধরনের যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ নির্দেশনা পরবর্তী ঘোষণা দেয়ার আগ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’র অগ্রভাগ বাংলাদেশের উপক‚ল স্পর্শ করেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, উপকূলীয় বেশ কয়েকটি জেলায় স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে তিন-পাঁচ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ¡াস হতে পারে। আবহাওয়া অধিদপ্তর মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরে ৭ নম্বর এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ৬ নম্বর বিপৎসংকেত জারি করেছে।
ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’র প্রভাবে চাঁদপুরে টানা বৃষ্টি ও বাতাসের গতি বেড়েছে। এর ফলে গতকাল সকাল ৬টা থেকে ছোট লঞ্চ এবং সকাল ১০টার পর থেকে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। বিআইডবিøউটিএ-এর চাঁদপুর বন্দর ও পরিবহন কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। চাঁদপুর লঞ্চঘাটে দায়িত্বরত নৌপথ পরিদর্শক (টিআই) শাহ আলম বলেন, সকাল ৬টা থেকে নির্ধারিত সময়ে এমভি আফিয়া, এমভি সোনার তরী-৩, এমভি ঈগল-৭, এমভি বোগদাদিয়া লঞ্চ চাঁদপুর ঘাট থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। তবে ১০টা ৪০ থেকে সব লঞ্চ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। যেসব লঞ্চ সকাল থেকে ছেড়ে গেছে, সেগুলোতে যাত্রী ছিল খুবই কম।
চাঁদপুরে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৬ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়। চাঁদপুরের আবহাওয়া কর্মকর্তা শামসুল আলম বলেন, আজ সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ২৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। ৯টার পরে বৃষ্টির পরিমাণ ও বাতাসের গতি আরও বেড়েছে।
‘মিধিলি’র প্রভাবে গতকাল ভোর থেকে বাগেরহাটে বৃষ্টির সঙ্গে থেমে থেমে দমকা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। বেলা একটা থেকে বাতাসের গতি কিছুটা বেড়েছে। মোংলা সমুদ্রবন্দর এলাকায় ৭ নম্বর বিপদসংকেত জারির পর মোংলা সমুদ্রবন্দরে পণ্য ওঠানামা বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছে বন্দরের হারবার বিভাগ। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার শাহীন মজিদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় বন্দর কর্তৃপক্ষ সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। বন্দরে বর্তমানে সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল, ইউরিয়া সারসহ মোট ১৭টি বিদেশি জাহাজ অবস্থান করছে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য পণ্য ওঠানামা বন্ধ রয়েছে। নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে নৌযানগুলোকে।
এদিকে বৃষ্টিতে বিপাকে পড়েছেন সুন্দরবনের দুবলার চরের শুঁটকিপল্লির জেলেরা। তাই দুর্যোগের কারণে মৌসুমের শুরুতেই বড় আর্থিক ক্ষতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি সাগর উত্তাল থাকায় মাছ ধরাও বন্ধ করে দিয়েছেন জেলেরা।
ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে বাগেরহাটে খোলা হয়েছে ৩৫৯টি আশ্রয়কেন্দ্র। উপক‚লবাসীকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য উপজেলা প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবকদের পক্ষ থেকে মাইকিং শুরু হয়েছে। বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক খালিদ হোসেন বলেন, উপক‚লবাসীকে আশ্রয়কেন্দ্রে
নিতে বলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনা খাবার ও পানির ব্যবস্থা করতে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বলা হয়েছে। এছাড়া ১ হাজার ৯২০ জন সিপিবি সদস্য এবং রেড ক্রিসেন্ট, বিএনসিসিসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ৫০০ জন সদস্য উপক‚লে কাজ শুরু করেছেন।
এদিকে ‘মিধিলি’র প্রভাবে ভোলার মেঘনা, তেঁতুলিয়া নদী এবং সাগরমোহনা উত্তাল হয়ে উঠেছে। তবে জোয়ারে পানির উচ্চতা বিপদসীমার নিচে আছে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হাসানুজ্জামান। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ভোলা-লক্ষীপুর নৌরুটে ফেরি চলাচল এবং ভোলা-লক্ষীপুর, ভোলা-ঢাকা, ভোলা-বরিশাল, ভোলা-পটুয়াখালী নৌপথে চলাচলকারী সব লঞ্চ সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে বলে জানান ভোলা নদীবন্দরের উপপরিচালক শহিদুল ইসলাম।
ভোলা ফেরিঘাট ব্যবস্থাপক পারভেজ খান বলেন, সকালে ভোলার ইলিশা ফেরিঘাট থেকে লক্ষীপুরের উদ্দেশে তিনটি ফেরি বাস-ট্রাক নিয়ে চলে গেছে। এগুলো লক্ষীপুরে নিরাপদে আশ্রয় নেবে। আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে আবার ছাড়বে।
উপক‚লীয় উপজেলা পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় প্রবল বৃষ্টি এবং দমকা হাওয়ায় জনজীবন কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কুয়াকাটা পর্যটন এলাকার বাসিন্দা সিকদার মোহাম্মদ আলমাস জানান, জলোচ্ছ¡াসে সৈকত এলাকা অন্তত চার-পাঁচ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। জোয়ারের পানি কুয়াকাটা সৈকতের জিরো পয়েন্টসংলগ্ন পর্যটন পুলিশ বক্স পর্যন্ত ছুঁই ছুঁই করছে। এদিকে উপজেলা প্রশাসন সাগরের পানির প্রবল চাপ দেখে কুয়াকাটা সৈকত থেকে ভ্রাম্যমাণ সব দোকানপাট সরিয়ে নিয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সতর্ক অবস্থানে আছে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দর কর্তৃপক্ষের উপপরিচালক (ট্রাফিক) আজিজুর রহমান বলেন, বন্দরে অবস্থানরত সব জাহাজকে ইতোমধ্যে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বন্দরের সব প্রকার অপারেশনাল কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে।
নি¤œচাপের খবরে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া ট্রলারগুলো কিনারায় ফিরে এসেছে। কুয়াকাটা আশার আলো জেলে সমবায় সমিতির সভাপতি নিজাম শেখ বলেন, ইতোমধ্যে ট্রলারগুলো শিববাড়িয়া নদীর পোতাশ্রয়ে নোঙর করে আছে। কিছু ট্রলার কুয়াকাটা, খালগোড়া, মহিপুর ও আলীপুর মৎস্য বন্দরের ঘাটেও নিরাপদ নোঙর করেছে বলে জানান আলীপুর মৎস্য আড়তদার সমবায় সমিতির সভাপতি ও লতাচাপলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনসার উদ্দিন মোল্লা।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘উপজেলার প্রান্তিক পর্যায়ের দুর্যোগকবলিত ২০টি পয়েন্টকে আমরা অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছি। সেসব পয়েন্টের জানমাল হেফাজত করার জন্য মুজিব কিল্লাসহ ৩৫টির মতো আশ্রয়কেন্দ্রকে দ্রæত প্রস্তুত করে ফেলেছি। আবহাওয়া পরিস্থিতি বেশি খারাপ হলে পুরো উপজেলার ২০টি মুজিব কিল্লাসহ ১৭০টি আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষজন নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারবেন।’
বৃষ্টির মধ্যে খেয়া পারাপার করছেন মানুষ। গতকাল সকালে ঝালকাঠি শহরের পালবাড়ি অতুল মাঝি খেয়াঘাটে বৃষ্টির মধ্যে খেয়া পারাপার করছেন মানুষ।
ঝালকাঠি-ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ঝালকাঠি জেলাজুড়ে রাত থেকে টানা বর্ষণ হচ্ছে। এর পাশাপাশি ঝোড়ো হাওয়া বইছে। এতে শীতের তীব্রতাও বাড়ছে। এর ফলে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে রিকশাচালকসহ খেটে খাওয়া মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে। সুগন্ধা, বিষখালীসহ জেলার বিভিন্ন নদ-নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে তিন-চার ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে।