দর্শনা কেরু এ্যান্ড কোম্পানীর শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়ন নির্বাচন বাতিলের আবেদন

প্রতিনিধি, চুয়াডাঙ্গা: চুয়াডাঙ্গার দর্শনা কেরু এ্যান্ড কোম্পানীর অরাজনৈতিক শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়ন নির্বাচন কার্যক্রম আওয়ামী লীগের দখলে রয়েছে। কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে চলছে আগামী ১৪ মার্চ নির্বাচনের আয়োজন। রবিবার (১০ মার্চ) চুয়াডাঙ্গা জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহবায়ক আসলাম হোসেন অর্ক ও সদস্য সচিব সাফফাতুল ইসলাম কেরু এ্যান্ড কোম্পানী বাংলাদেশ লিমিটেডের শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়নের নির্বাচন বাতিল ও পুনর্বিবেচনার জন্য জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে শিল্প উপদেষ্টা বরাবর একটি আবেদন পত্র পাঠিয়েছে। এছাড়া কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচন সংক্রান্ত পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ না করার অনুরোধ জানিয়ে গত রবিবার (৯ মার্চ) কুষ্টিয়া আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরের সহকারী পরিচালক তৌফিক হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিও উপেক্ষিত হয়েছে। যথারীতি চলছে নির্বাচন প্রক্রিয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে আবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের চিনি ও ডিস্টিলারী শিল্পের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান কেরু এ্যান্ড কোম্পানী বাংলাদেশ লিমিটেডের শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়ন নির্বাচন আগামী ১৪ মার্চ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু এই নির্বাচনকে ঘিরে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে এবং বাইরে নানা অনিয়ম,স্বৈরাচারী মানসিকতা ও গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকা-ের অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত এক মাসে কেরুজ এলাকায় প্রায় ১০-১২টি বোমা পাওয়া যায়,যা নিরাপত্তাজনিত মারাত্মক সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। গত ১৬ বছরে প্রতিষ্ঠানটিতে স্বৈরাচারী শাসনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। যারা স্বৈরাচারী সরকারকে আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে সমর্থন করেছে,কেরুর পণ্য চোরাচালানে জড়িত ছিল এবং প্রতিষ্ঠানে স্বৈরাচারী সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখেছে,তারাই আজ নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও যারা জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সরাসরি ছাত্র-জনতার উপর হামলা চালিয়েছে এবং গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকা-ে জড়িত ছিল,তারাও এখনো প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে রয়ে গেছে।

স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের এমপিদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী,যারা রাতের অন্ধকারে ভোটের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যা করতে সাহায্য করেছে,তারাও এ নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করছে। এই পরিস্থিতিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা ক্ষুন্ন হয়েছে। কেরুজ এলাকায় বোমা উদ্ধারের ঘটনা শুধু প্রতিষ্ঠানের কর্মকা-কে ব্যাহত করছে না, বরং কর্মচারী, শ্রমিক ও স্থানীয় জনগণের জীবনও ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং অযৌক্তিক। কেরু এ্যান্ড কোম্পানী বাংলাদেশ লিমিটেডের শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়ন নির্বাচন বাতিল করে পুনর্বিবেচনার ব্যবস্থা গ্রহণ করার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে স্বচ্ছতা,জবাবদিহিতা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী’।

এছাড়া কেরু শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচন সংক্রান্ত পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ না করার অনুরোধ জানিয়ে গত রবিবার (৯ মার্চ) কুষ্টিয়া আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরের সহকারী পরিচালক তৌফিক হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিও উপেক্ষিত হয়েছে। যথারীতি চলছে নির্বাচন প্রক্রিয়া। শ্রম দপ্তরের চিঠিতে বলা হয়েছে ‘সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক ও অংশীজন ব্যতীত কোন প্রকার আলোচনা না
নিরাপত্তা জনিত কারনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে, বিগত আওয়ামী ফ্যাসিষ্ট সরকারে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের কথিত সংসদ সদস্য আলী আজগার টগর ও তার ভাই দামুড়হুদা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলী মনছুর বাবু এবং তার নিকট আত্মীয়রা গোটা কেরু এ্যান্ড কোম্পানী বাংলাদেশ লিমিটেডকে গ্রাস করে ফেলে। বিগত ১৬ বছর যে ব্যবস্থাপনা পরিচালকই এ প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করতে এসেছেন তাকেই ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজের আয়ত্তে নিয়ে এসে তাকে সামনে রেখে বিভিন্ন অপকর্ম করেছে সাবেক সংসদ সদস্য টগর ও তার মনোনিত শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক।

গেল ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দেশের ৩০০ আসনের সংসদ সদস্য ও তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা পালিয়ে গেলেও কেরুতে নিয়োজিত আওয়ামী লীগের দোসরা বহাল তবিয়তে আছে এবং তাদের অপকর্ম অব্যাহত রেখেছে। কেরুর ডিস্টিলারী এবং দেশের ১৩টি মদ বিক্রির ওয়্যার হাউজে সাবেক সংসদ সদস্য আলী আজগার টগরের নিয়োগ দেয়া শ্রমিক ও কর্মচারী এখনো স্বপদেই আছে। ওয়্যার হাউজ গুলোতে বিক্রির জন্য যে মদ দর্শনা কেরু থেকে ট্রাকযোগে পাঠানো হয় ওই মদে পানি মিশিয়ে পরিমানে বেশী করে খোলা বাজারে বিক্রি করে সংসদ সদস্য টগরের সহযোগীরা একেক জন শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছে। ডিস্টিলারীতে উৎপাদিত বিদেশী ব্রান্ডের মদ চুরি করে বিক্রি করেও তারা হয়েছে কোটিপতি। যথেচ্ছা টাকার বিনিময়ে শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে শ্রমিক নেতারা হয়েছে অঢেল টাকা ও সম্পদের মালিক। কেরু শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক এবং হত্যা মামলার আসমী মাসুদুর রহমান মাসুদ সংসদ সদস্যের নিকটজন হয়ে কেরু কেন্দ্রীক এমন কোন অপরাধ নেই যে করেনি। কেরুকে সে ‘টাকা উৎপাদনের মেশিন’ হিসেবে ব্যবহার করেছে।

দর্শনা, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তিনি বাড়ী তৈরী ও জমি কিনেছেন। অবৈধভাবে মদ বিক্রি, টাকার বিনিময়ে শ্রমিক নিয়োগ, বিভিন্ন কারন দেখিয়ে কেরু থেকে টাকা তুলে হাতিয়ে নিয়ে তিনি কয়েক শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তার ছেলে সৌমিক হাসান রূপমকে ক্ষমতাবলে চাকরী দিয়ে বিভিন্ন মদ বিক্রির ওয়্যার হাউজ ইনচার্জ হিসেবে পদ দিয়ে রেখেছিলো। সে হত্যা মামলার আসামী হলেও বীরদর্পে প্রকাশ্যে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে। গত ৬ ফেব্রুয়ারী কেরু এ্যান্ড কোম্পানীর উৎপাদন প্রায় ১০ ঘন্টা বন্ধ করে কর্মকর্তাদের জিম্মি রেখে মাসুদুররহমানের ছেলে চিহ্নিত সন্ত্রাসী তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী সৌমিক হাসান রূপমের বদলী বাতিলের চেষ্টা করে তারই অনুসারী শ্রমিকরা। সে সময় কেরুতে প্রকাশ্য আওয়ামী শ্রমিক রূপি সন্ত্রাসীদের তান্ডবে হতবাক হয়ে গিয়েছিলো সাধারণ মানুষ।

বিগত দিনে দর্শনা কেরুর শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়ন নির্বাচনে বিজয়ীরা সকলেই ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর ছিলেন দর্শনা পৌর ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও হত্যা মামলার আসামী জয়নাল আবেদীন নফর। এবার ইউনিয়ন ভোটে সাধারণ সম্পাদক এবং দর্শনা পৌর ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মনিরুল ইসলাম প্রিন্স ইউনিয়নে সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন। এরা সাবেক সংসদ সদস্য আলী আজগার টগরের ছত্রছায়ায় থেকে অবৈধ স্বর্ণ চোরাচালান ও অস্ত্র ব্যবসা করতো এবং টগরের কাছের মানুষ হুন্ডি ব্যবসায়ী মানিচেঞ্জার গোলাম ফারুক আরিফের ঘনিষ্ঠজন। আরিফ বিগত ১৬ বছর ধরে বিভিন্ন অপকর্মের সাথে জড়িত ছিলো এবং এখনো রয়েছে। জয়নাল আবেদীন নফর,আসলাম আলী তোতা,আব্দুল মান্নান, তোফাজ্জেল হোসেন তপু,পারভেজ,অপু সরকার, নোমান,দর্শনা আমতলা পাড়ার হিরণ,কলেজ পাড়ার শরীফ,সাঈদ ড্রাইভার, সিরাজুল ইসলামের ছেলে জাহাঙ্গীর ও সংসদ সদস্য টগরের আপন ভাগ্নে মুন গত বছর ৪ঠা আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর লাঠি ও দেশী অস্ত্র নিয়ে হামলা করে।

এদিকে আওয়ামী লীগের অন্যতম ডোনার ও ফ্যাসিস্ট সরকারের অন্যতম ক্যাডার তৈয়ব আলী কেরুর সভাপতি পদে নির্বাচন করার জন্য মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন। অপরজন আওয়ামী লীগের ক্যাডার ও কেরু কেন্দ্রীক বিভিন্ন অপকর্মের হোতা কয়েক কোটি টাকার মালিক ফিরোজ আহমেদ সবুজ সভাপতি পদে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। তিনি সাবেক সভাপতি আজিজুল ইসলামের ছেলে। আগে ছিল যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান হাফিজ সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। তিনি চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলী আজগার টগরের একান্ত আস্থাভাজন। শুধু তাই নয় কেরু এখনও নিয়ন্ত্রণ করছে সাবেক সংসদ সদস্যের আত্মীয়স্বজন ও চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগকৃত শ্রমিকরা। এদের মধ্যে অন্যতম সাবেক সংসদ সদস্য টগরের ভাই মরহুম রফিকুল ইসলামের ছেলে দামুড়হুদা উপজেলা রঘুনাথপুর গ্রামের রাহাত,যিনি এখনো ঢাকা ওয়ার হাউজের গোডাউন পাহারাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে।

কেরুর শ্রমিক ইউনিয়ন অফিস সূত্রে জানা যায়, কেরুজ শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়নে ২০১৬-২০১৭ সেশনে আজিজুল ইসলাম সভাপতি ও সহিদুর রহমান সাধারণ সম্পাদক, ২০১৭-২০১৮ সেশনে সভাপতি পদে হাফিজুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান, ২০১৮-২০১৯ সেশনে সভাপতি পদে আজিজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক পদে মনিরুল ইসলাম প্রিন্স, ২০১৯-২০২০ ও ২০২০-২০২১ এবং ২০২১-২০২২ তিন সেশনে তৈয়ব আলী সভাপতি ও মাসুদুর রহমান সাধারণ সম্পাদক, ২০২২-২৩ সেশনে ফিরোজ সভাপতি ও মাসুদুর রহমান সাধারণ সম্পাদক ও সর্বশেষ ২০২৩-২৪ সেশনে ফিরোজ আহমেদ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান নির্বাচিত হন।
এদিকে দর্শনা কেরু শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়ন নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) আব্দুছ ছাত্তার বলেন,কুষ্টিয়া আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর থেকে যে চিঠি আমরা পেয়েছি তার লিখিত জবাব দেয়া হয়েছে। নির্বাচন কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
কুষ্টিয়া আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরের সহকারী পরিচালক তৌফিক হোসেন জানান,আমাদের পাঠানো চিঠির প্রেক্ষিতে নির্বাচন বন্ধ করেনি তারা। তারা কোন নিয়োমই মানছে না। তবে আমি শ্রম অধিদপ্তরের পরিচালক বরাবর বিস্তারিত জানাচ্ছি। দেখা যাক কি হয়।