দাম কমানোর আশ্বাস দিয়ে উল্টো পথে মোস্তাফা জব্বার

হামিদুর রহমান: চলতি বছরের শুরুতে ট্যাকনোক্র্যাট কোটায় ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন মোস্তাফা জব্বার। সে সময় দেশের প্রযুক্তি খাত এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি গ্রাহকদের সাশ্রয়ী মূল্য ইন্টারনেট ও ভয়েস কলের সুবিধা বাড়ানোসহ উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মানসম্পন্ন সেবা পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। যদিও দায়িত্ব গ্রহণের ১০ মাস পর পদত্যাগ করলেও কোনো আশ্বাসই বাস্তবায়ন করেননি। উল্টো বাড়ানো হয়েছে মোবাইল ফোনের কলরেট। অন্যান্য খাতেও উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখাতে পারেননি সদ্যবিদায়ী ট্যাকনোক্র্যাট এ মন্ত্রী।
দায়িত্ব গ্রহণের পর রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিডিবিএল ভবনে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) মিলনায়তনে সংবর্ধনায় মোস্তাফা জব্বার বলেছিলেন, ‘ইন্টারনেটের দাম কমানো ও গতি বৃদ্ধি করার পাশপাশি গ্রাহকদের মুঠোফোনে কথা বলার সুবিধা বাড়াতে ভয়েস কলের মূল্য কমানোই আমার প্রথম কাজ। ইন্টারনেট ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ আলোচনায় থাকছে না। ইন্টারনেটের দামও এখন সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে নেই। তাই আমার প্রথম কাজ হলো ইন্টারনেটের দাম কমিয়ে আনা। এজন্য যা যা করা দরকার
আমি তা-ই করব।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের যেভাবে ইন্টারনেট সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল সেভাবে পাচ্ছে না। টেলিকম কোম্পানিগুলো সরকারের কাছে ব্যান্ডউইথ কিনে ডেটা হিসেবে বিক্রি করছে। তাদের এটা করতে দেওয়া উচিত নয়। মোবাইল অপারেটরগুলো ভয়েস কলের জন্য মোবাইল টাওয়ার নির্মাণ করেছে, অথচ বেশি দামে ব্যবহারকারীদের কাছে ইন্টারনেট বিক্রি করছে। অন্যান্য দেশে ভয়েস কলের মূল্য কমলেও আমাদের দেশে কমছে না, বরং বাড়ছে। তাই আমার প্রথম প্রায়োরিটি ইন্টারনেট ও ভয়েস কলের দাম কমানো। তবে আমাদের ভয়েস কলের চেয়ে ডেটার ব্যবহারের দিকে মনোযোগী হতে হবে।’
ওই সময় মোস্তাফা জব্বার আরও বলেন, ‘আমি বিটিআরসির ওপর ক্ষুব্ধÑকেন তারা এখনও ইন্টারনেটের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারেনি, কমায়নি। টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ক্যানসারে আক্রান্ত। অনেক কর্মকর্তাই জানিয়েছেন, একটা কানাগলির মধ্য দিয়ে সবাই। সেই অবস্থা থেকে আমাদের বের হতে হবে।’
যদিও টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীর কোটায় প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর মানসম্পন্ন সেবা পেতে গ্রাহকদের প্রত্যাশা বাড়লেও বস্তুতপক্ষে সাশ্রয়ী ইন্টারনেট ও গতি কোনো কিছুর উন্নতি হয়নি। বরং তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ভয়েস কলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সাধারণ গ্রাহকদের ওপর একটি বাড়তি চাপ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, অন্যান্য দেশে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ভয়েস কলের রেট কমলেও আমাদের দেশে বেড়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, আগে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর ন্যূনতম কলরেট ছিল ২৫ পয়সা মিনিট, যেটি এখন বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪৫ পয়সা মিনিট। নতুন কলরেট অনুযায়ী, মোবাইল অপারেটরগুলো ৪৫ পয়সার নিচে কোনো কলরেট নির্ধারণ করতে পারবে না। একটি কলরেট সর্বোচ্চ দুই টাকা পর্যন্ত হতে পারবে।
অন্যদিকে আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে কল ড্রপ। গত এক বছরে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর কল ড্রপ হয়েছে ২২২ কোটি ১৫ লাখ মিনিট। এর মধ্যে গ্রাহকদের একের অধিক কল ড্রপ হয়েছে ৬৯ কোটি ৩৮ লাখ মিনিট। আর ফেরত দেওয়া হয়েছে মাত্র ২২ কোটি ছয় লাখ মিনিট। সেইসঙ্গে অপারেটরগুলোও সঙ্গে যোগ করেছে বাড়তি কৌশল। অর্থাৎ আগে কল ড্রপ হলে এসএমএসের মাধ্যমে গ্রাহককে অবহিত করলেও বর্তমান সময়ে কল ড্রপ হলেও সেটির তথ্য গ্রাহককে এসএমএসে জানানো হচ্ছে না। এই সুযোগে অপারেটরগুলো গ্রাহকদের বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।
গ্রাহকরা জানান, ‘দেশে উন্নত প্রযুক্তি চালু হলেও আশানুরূপ সেবা নেই। দেশে নামমাত্র ফোরজি চালু হলেও ইন্টারনেটে ধীরগতির পাশাপাশি কল ড্রপ আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য দেশে ভয়েস কলের মূল্য কমলেও আমাদের দেশে এমএনপির অজুহাতে ভয়েস কলের মূল্য বাড়ানো হয়েছে, যার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। এখন মফস্বলের অনেক এলাকায় নেটওয়ার্ক থাকে না।
এদিকে গ্রাহকদের প্রযুক্তি খাতে সর্বোচ্চ সুবিধা প্রদানে ইন্টারনেটের মূল্য কমানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও এখনও তা কমেনি, বরং নতুন করে ইন্টারনেটের মূল্য বাড়ানোর জন্য মোবাইল ফোন অপারেটগুলোকে চিঠি প্রদান করা হয়েছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরে দেশের সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়নের মধ্যে প্রযুক্তি খাত অন্যতম। এ বছর প্রযুক্তি উন্নয়নের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলোÑফোরজি প্রযুক্তি (চতুর্থ প্রজšে§র ইন্টারনেট সেবা), বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ও এমএনপি (মোবাইল নম্বর পোর্টেবিলিটি) চালু। ফোরজি ও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্প বাস্তবায়নের ভূমিকায় ছিলেন বর্তমান ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। যদিও প্রকল্পগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন বর্তমান ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। ফলে এ খাতেও তার কোনো অবদান নেই।
জানতে চাইলে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মন্ত্রী হিসেবে যে সময়টা পেয়েছি নিজের সক্ষমতা যথাসাধ্য কাজে লাগিয়েছি। এমন কোনো পরিস্থিতি হয়নি যে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছি। এই স্বল্প সময়ে যতটুকু কাজ করেছি, তাতে নিজের জায়গা থেকে আমার সেটিসফেকশন আছে। এই সময়ের মধ্য থেকে প্রযুক্তি খাতকে এগিয়ে নিতে যে বিষয়গুলো সামনে পড়েছে সবগুলো নিয়ে কাজ করেছি। আমার সাড়ে ৩১ বছরের তথ্যপ্রযুক্তির কর্মজীবন। সাড়ে ৩১ বছরের যে অভিজ্ঞতা ছিল তার আলোকেও কাজ করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইন্টারনেটের মূল্য আমি মনে করি আগের তুলনায় কমেছে। তবে কিছুদিন আগে আইটিও একটি রিপোর্ট দিয়েছে ইন্টারনেটের নতুন করে মূল্য নির্ধারণ করতে। আইটিওর রিপোর্টটি আমরা চেষ্টা করছি ইভ্যুলেশন করতে, অর্থাৎ একটা সল্যুশনে দাঁড় করাতে। তবে এটি দ্রুত সময়ে করা সম্ভব নয়, সময় লাগবে। কলরেটের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, এটি একতরফা বললেও ভুল হবে। কলরেটের মূল্য বরং কমেছে। এখানে অনেক রিলেটেড বিষয় যুক্ত, যেটি আমরা সমন্বয় করেছি।’