দারিদ্র্যমোচনে উত্তরাঞ্চলের সমতল ভূমিতে চা চাষ

মো. জাহাঙ্গীর আলম : পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার উপজেলা কৃষক আব্দুর রহমান বছর ছয়েক আগে তিন একর জমিতে অরগানিক চা চাষ শুরু করেন। এর আগে তিনি ওই জমিতে মৌসুমি ফসলসহ কৃষিপণ্য চাষ করতেন। তার জমির কিছু অংশ অনাবাদিও ছিল। ধান, আলু ও শাকসবজি চাষাবাদ করে কাক্সিক্ষত লাভ না হওয়ায় তিনি ক্ষুদ্রায়তনে চা চাষ শুরু করেন। তিনি গত বছর তিন একর জমিতে চা চাষ করে প্রায় পাঁচ লাখ টাকার সবুজ চা পাতা বিক্রি করেছেন। এতে তার প্রায় তিন লাখ টাকা লাভ হয়েছে। এই উপজেলার চা-চাষি রিপন বিশ্বাস দুই একর জমিতে চা চাষ করে দেড় লাখ টাকা লাভ করেছেন। অন্যদিকে উপজেলার বাসিন্দা রাজিয়া বেগম বসতবাড়ি ও এর চারপাশে দেড় একর জমিতে চা চাষ করে প্রায় সোয়া লাখ টাকা অধিক লাভ করেছেন। কৃষক আব্দুর রহমান, রিপন বিশ্বাস ও রাজিয়া বেগমের মতো কয়েকশ অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র কৃষক প্রচলিত কৃষিপণ্য চাষাবাদ বাদ রেখে অরগানিক চা চাষে বেশি মনোযোগী হচ্ছে। এ অঞ্চলে বাগানভিত্তিক চা চাষ ছাড়াও ক্ষুদ্রায়তন ও ক্ষুদ্র চা-চাষিরা নিজেরাই তাদের জমিতে চা বাগান করেছে। চা চাষে বেশি লাভ হয়, ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা কম বা নাই বললেই চলে। চা চাষ করে উত্তর অঞ্চলের পাঁচ জেলা পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাটের মানুষ এখন সচ্ছল, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে এবং দারিদ্র্যমোচন করে আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন করে এ জনপদের মানুষ চা চাষে সফল হয়েছে।

চা বাংলাদেশের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং ক্রমাগত নগরায়ণের ফলেও জনগণের শহরমুখিতায় চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। আর্থসামাজিক উন্নয়নের ফলেও চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়েছে। প্রায় চার দশক ধরে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। অনেক আগে থেকেই দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে চায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। জিডিপিতে চায়ের অবদান প্রায় দশমিক ৮১ শতাংশ। দেশে চায়ের প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে। লন্ডনভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি’ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চা উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে নবম। অনেক আগে থেকেই চা এদেশে একটি কৃষিভিত্তিক শ্রমঘন শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, আমদানি বিকল্প দ্রব্য উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানের সৃষ্টিতে গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাসকরণের মাধ্যমে চা চাষ জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

সিলেট ও চট্টগ্রামের প্রচলিত বৃহত্তাকার ‘টি এস্টেট’ বা ‘চা বাগান’-এর বাইরে এসে দেশের উত্তরের জনপদের পাঁচ জেলায় ক্ষুদ্রায়তন ও ক্ষুদ্র চা-চাষিরা নিজেরাই তাদের জমিতে অরগানিক চা বাগান করেছে। উত্তরের এ জনপদের সমতল ভূমিতে চা চাষের সফলতা এলাকার দারিদ্র্যমোচন, আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নসহ সৃষ্টি করেছে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান। একদিকে দরিদ্র পরিবারগুলোর আর্থিক অসচ্ছলতা দূর হয়েছে, অন্যদিকে অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়েছে।

সমতল ভূমিতে চা চাষ বদলে দিয়েছে হাজার হাজার কৃষক-শ্রমিক ও বেকার তরুণ-তরুণীদের ভাগ্য। চা বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, উত্তরাঞ্চলে চা বাগান, প্রক্রিয়াকরণ কারখানা ও প্যাকেটজাতকরণের জন্য ছোট কারখানাগুলোয় প্রায় ২৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। তাদের প্রায় অর্ধেকই নারী। চা বাগান ও কারখানাগুলোয় কাজ করে এখন অনেকেরই জীবনমানের পরিবর্তন হয়েছে। পরিবারে এসেছে সচ্ছলতা। তাছাড়া চা-শিল্প থেকে প্রতিবছর সরকারের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পাচ্ছে।

১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগে তৎকালীন পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এখানে পরীক্ষামূলকভাবে চা চাষ শুরু হয়। ২০০০ সালে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয়। সীমান্তঘেরা ভারতের গড়ে তোলা চা বাগান এবং দেশের পরীক্ষামূলক চা চাষে অনুপ্রাণিত হন দেশের চাষিরা। বাংলাদেশ চা বোর্ডের পরামর্শ ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় এগিয়ে আসে স্থানীয় ক্ষুদ্র চা-চাষিরা। বাংলাদেশ চা বোর্ডসূত্রে জানা যায়, বর্তমানে উত্তরের এ অঞ্চলে পাঁচ জেলায় নিবন্ধিত এক হাজার ৫১০ এবং অনিবন্ধিত পাঁচ হাজার ৮০০ ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান (২৫ একর পর্যন্ত) রয়েছে। পাঁচটি জেলায় বর্তমানে নিবন্ধিত ১০টি ও অনিবন্ধিত ১৭টি বড় চা বাগান (২৫ একরের ওপরে) রয়েছে। এ পর্যন্ত ১০ হাজার ১৭০ একর জমিতে চা চাষ সম্প্রসারণ করা হয়েছে। অপরদিকে দেশে মোট ১৬৭টি চা বাগান রয়েছে, যা বাংলাদেশ চা বোর্ড থেকে নিবন্ধনকৃত। এর মধ্যে ১২৯টি স্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত টি এস্টেট, ৩১টি স্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত চা বাগান এবং সাতটি অস্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত চা বাগান। ২০২০ সালে দেশের ১৬৭টি চা বাগান এবং ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান থেকে মোট আট কোটি ৬৩ লাখ ৯ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। উত্তর অঞ্চলের পাঁচ জেলার চা বাগানগুলো থেকে ২০২০ সালে প্রায় পাঁচ কোটি ১৩ লাখ কেজি সবুজ চা পাতা উত্তোলন করা হয়েছে, যা থেকে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ের ১৮টি চলমান চা কারখানায় প্রায় এক কোটি তিন লাখ কেজি চা উৎপন্ন হয়েছে। এগুলো প্রায় মোট চা উৎপাদনের ১০ শতাংশ। বিগত বছরের তুলনায় ২০২০ সালে এক হাজার ৪৯০ একর চা আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে ও সাত লাখ ১১ হাজার কেজি চা বেশি উৎপন্ন হয়েছে।

বর্তমান সরকারের আমলের ১২ বছরের (২০০৯-২০২০) উত্তরের পাঁচ জেলায় চা আবাদের পরিমাণ প্রায় সাড়ে চার গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১০ হাজার ১৭০ একর (৪১১৭ হেক্টরে উন্নীত হয়েছে এবং  চায়ের উৎপাদন ১৬ গুণ বেড়ে এক কোটি তিন লাখ কেজিতে উন্নীত হয়েছে, যা এযাবৎকালে উত্তরের জনপদের চা-শিল্পের সর্বোচ্চ রেকর্ড। পঞ্চগড়ে চা চাষের ফলে এ এলাকার সরাসরি প্রায় ২০ হাজার জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

উত্তরের পাঁচ জেলার পর এবার বৃহত্তম ময়মনসিংহের শেরপুর ও নেত্রকোনার কিছু অংশে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়েছে। গারো হিলস টি কোম্পানি নামীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গারো পাহাড় অঞ্চলে চা বাগানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ অঞ্চলের আগ্রহী চাষিদের মাঝে চা চাষের প্রশিক্ষণ ও চারা বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উদ্যোক্তাদের ধারণা, গারো পাহাড়ি জনপদে দারিদ্র্যমোচন ও কর্মসংস্থানের পাশাপাশি উৎপাদিত চা এ জেলাগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।

দেশে চা আবাদ বৃদ্ধি করে চায়ের উৎপাদন বাড়িয়ে নিজস্ব চাহিদা মিটানো এবং এর মাধ্যমে দারিদ্র্যমোচনের লক্ষ্যে সরকার নানা ধরনের কর্মসূচি/প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সরকার ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান সম্প্রসারণ ও দারিদ্র্যমোচনে আর্থসামাজিক উন্নয়নে পাঁচ বছর মেয়াদি তিনটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে ক. এক্সটেনশন অব স্মল হোল্ডিং টি কাল্টিভেশন ইন চিটাগং হিল ট্র্যাক্টস; দুই. এক্সটেনশন অব স্মল হোল্ডিং টি কাল্টিভেশন ইন নর্দান বাংলাদেশ এবং তিন. ইরাডিকেশন অব রুর‌্যাল প্রভারটি বাই এক্সটেনশন অব স্মল হোল্ডিং টি কাল্টিভেশন ইন লালমনিরহাট। দেশের চা চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে চায়ের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে পঞ্চগড়সহ উত্তরের পাঁচ জেলায় এক্সটেনশন অব স্মল হোল্ডিং টি কাল্টিভেশন ইন নর্দান বাংলাদেশ নামে পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চা বোর্ড। এই প্রকল্পের আওতায় ২০২১ সালের জুনের মধ্যে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাটে এক হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে নতুন করে চা চাষ করা হবে। অপরদিকে উত্তরের একটি জেলায় ‘ইরাডিকেশন অব রুর‌্যাল প্রভার্টি বাই এক্সটেনশন অব স্মল হোল্ডিং টি কাল্টিভেশন ইন লালমনিরহাট’ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ২০২১ সালের জুনের মধ্যে লালমনিরহাটে ১০০ হেক্টর জমিতে চা চাষাবাদ বৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্যমোচন করা হবে। এছাড়া এক্সটেনশন অব স্মল হোল্ডিং টি কাল্টিভেশন ইন চিটাগং হিল ট্র্যাক্টস প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে পার্বত্য এলাকায় ৩০০ হেক্টর জমিতে নতুন করে চা চাষের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ আর্থসামজিক উন্নয়নে অবদান রাখা সম্ভব হবে।

জাতীয় চা নীতিতে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ সম্প্রসারণ সম্পর্ক বলা হয়েছে, উত্তর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় সমতল ভূমিতে, পার্বত্য জেলাগুলোয় এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ শুরু হয়েছে। জাতীয় চা নীতি অনুযায়ী এসব এলাকার চা-চাষিদের চা চাষের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ, ভর্তুকি এবং চা চারা দেয়া হচ্ছে। এ নীতিতে আরও বলা হয়েছে, ক্ষুদ্র চা-চাষিদের আয়বর্ধনের জন্য সাথি ফসলের চাষ করতে হবে। স্বল্পকালীন ও ভূমির জৈব উপাদান সমৃদ্ধ করে এরূপ ফসল সাথি হিসেবে চাষ করতে হবে। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় গবেষণা করবে এবং লব্ধজ্ঞান ক্ষুদ্র চা-চাষিদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করবে। এছাড়া ক্ষুদ্রায়তন নিবিড় চা চাষের জন্য ও চা এলাকা সম্প্রসারণের জন্য বিটিআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত ও প্রেসক্রাইবড ক্লোনস, বাই-ক্লোনাল ও পলি-ক্লোনাল চা বীজ ব্যবহারে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

দেশের সমতল ভূমিতে চা চাষের জন্য উত্তরের জেলাগুলো অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এলাকা। সরকার চায়ের চাষ সম্প্রসারণের জন্য চাষিদের বিভিন্ন সহায়তার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করছে। কৃষকরা উদ্বুদ্ধ হয়ে সমতল ভূমিতে চা চাষ কার্যক্রম বাড়াচ্ছে। সমতল ভূমিতে চা চাষ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। চায়ের উৎপাদনের পাশাপাশি কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও দারিদ্রমোচনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে উত্তর অঞ্চলের সমতল ভূমির এই চা চাষ।

পিআইডি নিবন্ধন