ড. আর এম দেবনাথ: কয়েক দিন আগে একটা গুরুত্বপূর্ণ জরিপের তথ্য খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। এ জরিপটির নাম ‘খানা আয় ও ব্যয় জরিপ-২০১৬’। এর থেকে আমরা দেশে দারিদ্র্যের অবস্থা কী, তা যেমন জানতে পারছি তেমনি জানতে পারছি পরিবারপিছু আয়-ব্যয়ের হিসাব, দারিদ্র্য হ্রাসের গতি, আয়-বৈষম্য, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, জেলাওয়ারি দারিদ্র্যের অবস্থা, সবচেয়ে ধনীদের আয় এবং সবচেয়ে গরিবদের আয় ইত্যাদি। এছাড়া এ জরিপ থেকে জানা যাচ্ছে বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবহার, প্রোটিন গ্রহণ, বিদ্যুৎ বিতরণ, স্যানিটারি ব্যবস্থা, বাড়িঘরের অবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে। এসব বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে ‘দারিদ্র্য বিমোচন’, যা সরকারের মূল এজেন্ডা। বিশ্বও তাকিয়ে থাকে দারিদ্র্যের অবস্থা কী, তা জানতে। খুবই গর্ব করে বলা যায়, বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনের অগ্রগতি প্রশংসাজনক। ২০১৬ সালে দেশে ‘সার্বিক দারিদ্র্য’ ছিল ২৪ দশমিক তিন শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ জন লোকের মধ্যে ২৪ জন ছিল ‘দারিদ্র্যসীমা’র নিচে, যারা দুই বেলা ভাত পায়নি। ২০০০ সালে এর পরিমাণ ছিল ৪৮ শতাংশ। এর অর্থ ১৬ বছরে দরিদ্র লোকের সংখ্যা ৪৮ থেকে ২৪ জনে নামানো গেছে। এ তথ্যই শেষ নয়। ‘সার্বিক দারিদ্র্যের’ মধ্যে লুকিয়ে আছে ‘অতিদরিদ্র’, যারা সত্যি সত্যি এক বেলা ভাতও জোগাতে পারে না। এর সংখ্যা ২০১৬ সালে ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। বলা বাহুল্য, ২০০০ সালে অতিদরিদ্রের সংখ্যা ছিল ৩৪ শতাংশ। এ ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, ১৬ বছরে অতিদরিদ্র অর্ধেকে হ্রাস পেয়েছে।
এতক্ষণ শতকরা হিসাবে তথ্যগুলো দিলাম। এ তথ্যেই আমাদের মন খারাপ হওয়ার কথা কিন্তু যদি সংখ্যায় দেওয়া যায়, তাহলে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো। দেখা যাচ্ছে, ২০১৬ সালে ‘সার্বিকভাবে দরিদ্র’ ছিল প্রায় চার কোটি লোক এবং অতিদরিদ্র প্রায় তিন কোটি লোক। উল্লেখ্য, এই সংখ্যক লোক দরিদ্র এবং অতিদরিদ্রÑদারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে আমাদের প্রশংসাজনক সাফল্য সত্তে¡ও। সাফল্য সত্তে¡ও স্বাধীনতার ৪৫ বছরে চার কোটি লোক দুই বেলা ভাত জোগাড় করতে পারে না। আমি ‘দারিদ্র্যের’ সংজ্ঞা নিয়ে ক‚টতর্ক তুলছি না। সেই তর্ক চললে বিষয়টি ভীষণ জটিল হয়ে উঠবে। কারণ যদি চিকিৎসার সুবিধা, লেখাপড়ার সুবিধা, পানীয় জলের সুবিধা ইত্যাদি দারিদ্র্যের সংজ্ঞার মধ্যে আনা হয়, তাহলে বিষয়টি জটিল হয়ে পড়বে। আর আমেরিকানদের ‘দারিদ্র্যের’ সংজ্ঞার সঙ্গে আমাদের সংজ্ঞা মেলালেও ভিন্ন ফল পাওয়া যাবে। অতএব, ওই দিকে না গিয়েও বলা যায়, স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও চার কোটি লোক ভাত পায় না। অথচ দেশে চালের অভাব নেই। ৪৫ বছরে চাল উৎপাদন অন্তত সাড়ে তিনগুণ বেড়েছে। এতদসত্তে¡ও ক্রয়ক্ষমতার অভাবে এ লোকগুলো ভাত জোগাড় করতে পারে না। দুঃখের বিষয়, পরিতাপের বিষয়।
এখানে শেষ করতে পারলে ভালোই হতো। তা হওয়ার নয়। এতক্ষণ যা বললাম, সেসব হচ্ছে জরিপের গড় তথ্য (অ্যাভারেজ) । গড় যে চিত্র দেয়, তাতেই মন খারাপ হয়। যদি জেলাওয়ারি তথ্য নেওয়া যায়, তাহলে মন আরও ভীষণ খারাপ হয়। কারণ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের দারিদ্র্যের খবর বিভিন্ন রকম। কোথাও কোথাও দারিদ্র্যের চিত্র ভয়াবহ। খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০১৬ অনুসারে দেশের পাঁচটি জেলার ‘দারিদ্র্য অবস্থা’ ভয়াবহ। কুড়িগ্রাম জেলায় ১০০ জনের ৭১ জনই দারিদ্র্যসীমার নিচে। চিত্রটি কি ভয়াবহ নয়? দিনাজপুর, বান্দরবান, মাগুরা এবং বাড়ির কাছের কিশোরগঞ্জ জেলার অবস্থাও প্রায় একই। দিনাজপুরে ১০০ জনের মধ্যে ৬৪ জন দারিদ্র্যসীমার নিচে, বান্দরবানে ৬৩, মাগুরায় ৫৮ ও কিশোরগঞ্জে ৫৪ জন। ভাবা যায়, দারিদ্র্যের অবস্থা কী? তবু এসব জেলা নয়, সারা দেশের আরও অনেক জেলার অবস্থাই এরকম। গাইবান্ধা, লালমনিরহাট জেলার দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে যথাক্রমে ৪৭ জন ও ৪২ জন। এর বিপরীতে আনন্দের খবর আছে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, গাজীপুর ও ফরিদপুরের জন্য। আনন্দের খবর ঢাকা ও নরসিংদী জেলার জন্য। নারায়ণগঞ্জ জেলায় দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস ১০০ জনের মধ্যে মাত্র আড়াইজনের, মুন্সীগঞ্জে তিনজনের. মাদারীপুরে তিন দশমিক সাতজনের, গাজীপুরে সাতজনের ও ফরিদপুরে আটজনের। ঢাকা ও নরসিংদী জেলার দরিদ্র লোকের সংখ্যা শতকরা ১০ জন করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজার, সিলেটেও দরিদ্র লোক ১০ থেকে ১৩ শতাংশের মধ্যে। এসব তথ্য থেকে কী বোঝা যায়? বোঝা যাচ্ছে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দারিদ্র্যের প্রকোপ বেশি। উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। তাদের এ অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে। ধরা যাক কুড়িগ্রামের কথা। এ কুড়িগ্রাম দুদিন পর পর খবরের কাগজের শিরোনাম হয়। অথচ যেই তিমিরে তারা ছিল, আজও তা-ই। আশ্চর্য আরেকটি খবর আছে। ‘মধুময়’, ‘ক্যাশপ্রাচুর্যময়’ এবং ‘আনন্দময়’ রাজধানী ঢাকা শহরের আশপাশ অঞ্চল প্রায় দারিদ্র্যমুক্ত। অথচ অতি নিকটস্থ জেলা কিশোরগঞ্জ অন্ধকারে। এখান থেকে কত বড় বড় নেতা এসেছেন এবং এখনও আছেন। তারপরও দেখা যাচ্ছে, এর স্থান কুড়িগ্রামের পাশে। অথচ যোগাযোগব্যবস্থা এখানে উত্তম, কৃষিকাজে এই জেলা উত্তম, পাটের অঞ্চল কিশোরগঞ্জ। বিশাল নদীবন্দর ভৈরব কিশোরগঞ্জ জেলায়। চিনিকল ছিল কিশোরগঞ্জে আগে থেকেই। খাল-বিল-হাওরের মাছে ভর্তি কিশোরগঞ্জ। কুলিয়ারচরের মাচের কথা কে না জানে। এত সুবিধার পরও এ জেলার দারিদ্র্য পরিস্থিতি উন্নয়নের একটা বড় বাধা বলে আমার মনে হচ্ছে। আরও বোঝা যায়, রাজধানীর নৈকট্য নয়, শুধু ‘রেমিট্যান্স’ও দারিদ্র্য বিমোচনে একটা ভ‚মিকা রাখছে। ‘এন্টারপ্রাইজও’ (উদ্যোগ) কি কোনো ভ‚মিকা রাখছে? এসব খুঁজে বের করা দরকার। কারণ দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছে বলে দাবি করব আর দেশের বিভিন্ন অঞ্চল অন্ধকারে থাকবে, কেউ খাবে কেউ খাবে না, এটা কেমন করে হয়। এখানে সরকারি উন্নয়ননীতির বড় ব্যর্থতা রয়েছে বলেই আমি মনে করি। দেশের সব অঞ্চলের মানুষের সম-উন্নয়নের নীতি দরকার। নতুবা যেভাবে আঞ্চলিক বৈষম্য বাড়ছে আগামীদিনে তা মহীরুহে পরিণত হবে।
শুধু আঞ্চলিক বৈষম্য নয়, দেখা যাচ্ছে আয়-বৈষম্যও দিন দিন বাড়ছে। আমরা মুখে মুখে বলছি, গরিব আরও গরিব হচ্ছে, ধনী আরও ধনী। এটা এখন শুধু মুখের কথা নয়। তথ্যেও তা প্রমাণিত। খানা জরিপের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, মোট আয়ের মাত্র এক শতাংশ পায় দেশের সর্বনি¤œ ১০ শতাংশ গরিব। বিপরীতে ১০ শতাংশ ধনীর হাতে ৩৮ শতাংশ আয়। মারাত্মক তথ্য। ধনীদের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভ‚ত হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে ঘটছে আরেকটি জিনিস। ‘দারিদ্র্য হ্রাসের গতি’ কমছে দিন দিন। অর্থাৎ আগে যত সংখ্যক মানুষ ‘দারিদ্র্যসীমার’ উপরে উঠত, এখন উঠছে কম। ২০১০ থেকে ২০১৬ সময়কালে এ হার ছিল মাত্র এক দশমিক দুই শতাংশ। অথচ তা ২০০০ থেকে ২০০৫ সময়কালে ছিল এক দশমিক ৭৮ শতাংশ। খুবই দুশ্চিন্তার খবর। এর অর্থ আরও অনেক সময় লাগবে দেশের সব মানুষকে টেনে তুলতে। বলা বাহুল্য, এর কারণ বৈষম্য বৃদ্ধি, ধনী-গরিবের পার্থক্য বৃদ্ধি। বৈষম্য অর্থনেতিক প্রবৃদ্ধির সুফল ধনী লোকের হাতে তুলে দেয়।
খানা জরিপের আরও কিছু তথ্য আছে, যা কিছুটা স্বস্তিদায়ক। যেমন গ্রামাঞ্চলের বাড়িঘরের চিত্র। এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ইটের বাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। ২০১০ সালে ২৫ শতাংশ লোকের বাড়িঘর ছিল ইটের। ২০১৬ সালে তা ৩০ দশমিক পাঁচ শতাংশ। বিশুদ্ধ পানীয় জলের প্রাপ্যতার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে কিছুটা উন্নতি। টিন ও কাঠের বাড়ির সংখ্যাও বেশি বেড়েছে। ৩৮ শতাংশের স্থলে এখন ৪৯ শতাংশ লোকের বাড়িঘর ইট ও কাঠের। স্যানিটারি ব্যবস্থায় ৬১ শতাংশ বাড়িঘর এসেছে। বিদ্যুতের আওতায় ৭৬ শতাংশ বাড়িঘর। সাত বছরের ঊর্ধ্বে বয়স, এমন জনমানুষের ৬৫ শতাংশ সাক্ষর। এসব খবর নিশ্চিতভাবেই সুখকর। কিন্তু একটা খবর পাওয়া যাচ্ছে, তা নিশ্চিতভাবেই দুশ্চিন্তার। পরিবারের আয়-ব্যয়ের যে হিসাব খানা জরিপ-২০১৬ থেকে পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যায় আয়ের তুলনায় পরিবারের খরচ বেশি বাড়ছে। ২০১০ সালে পরিবারের মাসিক আয় ছিল ১১ হাজার ৪৭৯ টাকা। ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা। বিপরীতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়, পরিবারের মাসিক ব্যয় এ সময়ের মধ্যে ১১ হাজার ২০৩ টাকা থেকে ১৫ হাজার ৯১৫ টাকায় উন্নীত হয়েছে। এর অর্থ ২০১০ সালে পরিবারে সঞ্চয় থাকত ২৭৯ টাকা, এখন তা মাত্র ৩০ টাকা। অর্থাৎ ব্যয় বাড়ছে বেশি। এটা মূল্যস্ফীতির তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ কারণেই দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে ‘অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়’ প্রায় এক দশক ধরে স্থবির হয়ে আছে। অথচ আমাদের সঞ্চয় দরকার। সঞ্চয়কে সরকার ব্যবহার করতে পারে বিনিয়োগ হিসেবে। আর সঞ্চয়কারী একে ব্যবহার করতে পারে বিপদের দিনে। আমাদের মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্তের বিপদ পদে পদে। তার অসুখবিসুখের সময় যে খরচ হয়, তা রাষ্ট্র দেয় না। তাকেই খরচ করতে হয়। বেকার হলে তাকে উপোস থাকতে হয়। বেকার ভাই-বোনদের পালতে হয়। বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখতে হয়। এমনকি বেকার আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীকেও দেখতে হয়। অধিকন্তু তারা ধর্মীয়ভাবে ‘জাকাত’ও দেয়। এত কিছু বহন করার পর তার আর সঞ্চয় থাকে না। অথচ তা দরকার। বাংলাদেশ কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্র নয়। যুক্তরাষ্ট্রে পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র নাগরিকদের সুখদুঃখ দেখভাল করে। সেখানে নাগরিকের সঞ্চয়ের প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমাদের আছে। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রের উচিত মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্তের আয় বাড়ানো। এর একটা পথ হচ্ছে তাকে করের আওতা থেকে মুক্তি দেওয়া। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ করের আওতা থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া। এতে তার সঞ্চয় বাড়বে। সে ভোগও বেশি করতে পারবে। সরকার তো পরোক্ষ ও উৎসে কর কর্তনের দিকেই যাচ্ছে। অতএব মধ্যবিত্তের সঞ্চয় বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে বাধা কোথায়?
অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক