Print Date & Time : 17 August 2025 Sunday 4:47 am

দারিদ্র্য হ্রাসে স্বাস্থ্যবিমা

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: বাংলাদেশে চিকিৎসায় অত্যধিক ব্যয়, ভুল চিকিৎসা ও দরিদ্রতা দেশে চিকিৎসা খাতে ব্যক্তিগত ব্যয় (আউট অব পকেট এক্সপেনসেস ওওপি) এশিয়ার মধ্যে সর্বাধিক। চিকিৎসাসেবা সংগ্রহে অত্যধিক ব্যয়ের মূল কারণ হচ্ছে সরকারি আনুকূল্যে ওষুধের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি, রোগ নির্ণয় ও শৈল্য চিকিৎসায় কল্পনাতীত অতিরিক্ত চার্জ ও অপচিকিৎসা।

শৈল্য চিকিৎসায় কত গুণ বেশি চার্জ করা হয়, সে সম্পর্কে দু-একটি উদাহরণ দিচ্ছি। বয়োবৃদ্ধদের ছানি কেটে চোখে নতুন লেন্স বসাতে  (IOL)  সর্বসাকুল্যে খরচ হাজার টাকার অনধিক। ফেকো পদ্ধতিতে ছানি কাটার অপারেশন করলে খরচ দ্বিগুণ হয়। ফেকো পদ্ধতিতে অপারেশন করলে রোগীর সময় সাশ্রয় হয়। বয়োবৃদ্ধদের এত সময় সাশ্রয়ের প্রয়োজন কতটুকু তা বিবেচ্য হওয়া উচিত। বিভিন্ন ক্লিনিকে আইওএলের জন্য ৫০ হাজার টাকা ও ততোধিক এবং ফেকো অপারেশনের জন্য এক থেকে দেড় লাখ টাকা চার্জ করা হয়। কতিপয় চক্ষু চিকিৎসক ভাঁওতা দিয়ে ৫০ হাজার টাকায় প্রদাহ নিবারক ইনজেকশনও বিক্রি করে থাকেন ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানির অনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে। এরূপ অতিরিক্ত চার্জ দিনে-দুপুরে ডাকাতির তুল্য নয় কি? শিক্ষিত জনসাধারণ ও গণমাধ্যম কর্মীরা এরূপ অত্যধিক অস্বাভাবিক চার্জ সম্পর্কে প্রায় কোনো প্রশ্ন তোলেন না। অর্থোপেডিকস, কার্ডিয়াক ও নিউরোসার্জন, ইউরোলজিস্টরা অপারেশনের জন্য এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা চার্জ করে থাকেন।

১৯৯৪ সালে বিআইডিএস (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের গবেষক ড. হোসেন জিল্লুর রহমান ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন যে, বাংলাদেশের দরিদ্রতা হ্রাস না পাওয়ার তিনটি কারণের মধ্যে দ্বিতীয় মুখ্য কারণ হচ্ছে ভুল চিকিৎসা, অপচিকিৎসা, চিকিৎসায় অত্যধিক ব্যয়, অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ থেকে বঞ্চিত হওয়া। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সরকারের অমানবিক ব্যবহার দরিদ্রতা নিরসন না হওয়ার অপর দুই কারণ বলে তিনি উল্লেখ করেছিলেন১।

বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেনও সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়া ও চিকিৎসাসেবা সংগ্রহে অত্যধিক ব্যয়কে দরিদ্র পরিবারের ক্রম অবনতির জন্য দায়ী করেছেন২।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডা. জিম ইয়ংকিং বৈশ্বিক বৈষম্য ও অসামঞ্জস্য এবং দরিদ্র পরিবারদের স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়াকে দরিদ্রতার মুখ্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘Dying for ‡rowth: ‡lobal Inequality and Health for the PoorÕ eB‡q3|

উল্লেখ্য, ১৫০ বছর আগে ১৮৪২ সালে প্রায় একই তথ্য প্রকাশ করেছিলেন লন্ডন ওয়েস্টমিনস্টার মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের প্রকৌশলী স্যার এডউইন চ্যাডউইক  (Sir Edwin Chadwick) বিলেতের মহামারির প্রেক্ষিতে লিখিত রিপোর্টে। তিনি লিখেছিলেন দূষিত পরিবেশ ও দূষিত পানি সরবরাহ, গলিত বর্জ্য ও রাস্তার নালা-নর্দমার পাইপ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে রোগ সৃষ্টি হয় এবং রোগ ও রোগের চিকিৎসায় অতিরিক্ত ব্যয় দরিদ্রতার মূল কারণ।

সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসকের অনুপস্থিতি সর্বজনজ্ঞাত বিষয়। ২০১৩ সালের ৩ জুলাই  তৎকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী অধ্যাপক এএফএম রুহুল হক বলেছিলেন, হাসপাতালে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি স্বাস্থ্যসেবার বড় সমস্যা৫, ৬। সাত বছরেও সে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। এটা সরকারের চরম ব্যর্থতা। হাসপাতালে সরকারি ওষুধ কোম্পানি ইডিসিএলের  প্রস্তুত ভালো ওষুধ মজুত থাকা সত্ত্বেও হাসপাতালে দু-চারজন চিকিৎসক যারা পালা করে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে থাকেন, তারা রোগীকে হাসপাতালের ওষুধ না দিয়ে অতিরিক্ত মূল্যে বাইরে থেকে ওষুধ কিনে নেয়ার জন্য প্রেসক্রিপশন দেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হাসপাতালের অভ্যন্তরে বিবিধ ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের ভিড় ও চিকিৎসকদের সঙ্গে লেনদেনের বিষয় সর্বজনবিদিত। তাই রেজিস্টার্ড বিশেষজ্ঞ ও ভুয়া বিশেষজ্ঞের ব্যবস্থাপত্রে ভয়ানক মিল পাওয়া যায়। প্রায়ই বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ভুয়া চিকিৎসক ও ভুয়া পীরের সংবাদ প্রকাশ পাচ্ছে। রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের কর্মস্থলে অনুপস্থিতির সুযোগে হাতুড়ে ডাক্তাররা কেবল গ্রামগঞ্জে নয়, এমনকি

বড় বড় শহরেও সাইনবোর্ড টানিয়ে ভুয়া ডিগ্রি উল্লেখ করে অনেকে বিশেষজ্ঞ সেজেও চিকিৎসা দেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) কোনো কার্যকর ভূমিকা পরিলক্ষিত হয় না।

সামাজিক বিমা সৃষ্টির কাহিনি

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ১০০ বছর আগে ১৮৭১ সালে জার্মানির রাজনীতিবিদ অটোভন বিসমার্ক বহুধাবিভক্ত জার্মানিকে একত্র করে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেন এবং জার্মান নাগরিকদের দেশ ত্যাগ প্রতিহত করার নিমিত্তে একে একে বিভিন্ন প্রকার সামাজিক বিমার প্রচলন করেন। দরিদ্র পরিবারকে নিখরচায় স্বাস্থ্য সুবিধা দেয়ার জন্য জার্মানিতে ওটোভন বিসমার্ক প্রথম সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমার প্রচলন করেন। তিনি ১৮৮৩ সালে অসুস্থ নাগরিকদের চিকিৎসাসেবা প্রদান আইন চালু করেন। পরের বছর দুর্ঘটনা বিমা ক্ষতিপূরণ আইন এবং ১৮৮৯ সালে বয়োবৃদ্ধদের সেবা বিমা আইন প্রচলন করেন। অটোভন বিসমার্ক ১৮৯৮ সালের ৩০ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।

বিসমার্কের সামাজিক বিমার অনুকরণে ১৮৮৮ সালে অস্ট্রিয়া, ১৮৯১ সালে হাঙ্গেরি, ১৯০১ সালে লুক্সেমবার্গ, ১৯০৯ সালে নরওয়ে ও ১৯১১ সালে সুইজারল্যান্ডে সামাজিক বিমার প্রচলন শুরু হয়। ব্রিটেনে ১৯১৯ সালে বোর্ড অব ট্রেডের সভাপতি উইন্সটন চার্চিলের নেতৃত্বে প্রথম বেকার বিমা চালু হয়। ১৯৪৬ সালের ৬ নভেম্বর ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস আইন অনুমোদিত হয় এবং ১৯৪৮ সালের ৫ জুলাই ব্রিটেনের সব নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী এনুরিল বিভানের নেতৃত্বে জাতীয় স্বাস্থ্যবিমার মাধ্যমে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস চালু হয় সব শ্রেণির চিকিৎসকদের বিরোধিতা সত্ত্বেও।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে স্থানীয় পর্যায়ে সীমিত আকারে স্বাস্থ্যবিমা প্রচলনের উদ্যোগ নেন। যুক্তরাষ্ট্রে দরিদ্রদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা মেডিকেইডর প্রচলন হয় ১৯৬৫ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসকরা মেডিকেএইডের ভয়ানক বিরোধিতা করেনÑমেডিকেএইডকে তারা ‘কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যবিমা মূলত প্রাইভেট ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত বিধায় প্রিমিয়াম খুব বেশি। অন্যপক্ষে কানাডা, ব্রিটেন ও ইউরোপের প্রায় দেশে জাতীয় স্বাস্থ্যবিমা সরকার-নিয়ন্ত্রিত বলে কম খরচে উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা রয়েছে। সাধারণত সব সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও কর্মীদের বেতন থেকে এক-দুই শতাংশ স্বাস্থ্যবিমার জন্য কেটে রাখা হয়। তাদের দেয় প্রিমিয়ামের সঙ্গে সরকার সমপরিমাণ প্রিমিয়াম যোগ করেন। নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সুইডেন ও ডেনমার্কে স্বাস্থ্যবিমার জন্য পাঁচ শতাংশ কাটা হয় এবং সরকার থেকে সমপরিমাণ প্রিমিয়াম যোগ করা হয়। সেখানে জাতীয় স্বাস্থ্যবিমার পরিধি অনেক বেশি বিস্তৃত। উন্নত দেশগুলোয় বাসস্থান ও বেকার ভাতা এবং বয়োবৃদ্ধদের সেবা সামাজিক স্বাস্থ্যবিমার অন্তর্ভুক্ত।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ১৯৭৩ সালে সাভারের গ্রামে স্থানীয়ভাবে প্রতি পরিবারের মাসিক দুই টাকায় স্থানীয় স্বাস্থ্যবিমার প্রচলন করে। ধনী-দরিদ্র সব পরিবারের একই প্রিমিয়াম সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। ধনীরা অতিরিক্ত প্রিমিয়াম দিয়ে অধিকতর সুবিধা দাবি করতে থাকে এবং দরিদ্ররা কম প্রিমিয়াম যুক্তিসংগত মনে করতেন। পরবর্তীকালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র সামাজিক শ্রেণিভিত্তিক স্বাস্থ্যবিমার প্রচলন করেÑ১. অতি দরিদ্র, ২. দরিদ্র, ৩. নিম্ন মধ্যবিত্ত, ৪. মধ্যবিত্ত, ৫. উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং ৬. ধনী।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের স্থানীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্যবিমার সফলতা সীমিত। দরিদ্র পরিবাররা ৬০ শতাংশ স্বাস্থ্যবিমা গ্রহণ করেছেন। মধ্যবিত্তরা ১৫ শতাংশের অনধিক এবং ধনীরা আরও কম। ফলে এ স্বাস্থ্যবিমা পদ্ধতি স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারেনি। দরিদ্র পরিবাররা সামান্য প্রিমিয়াম দিয়ে থাকে। যাদের গণ স্বাস্থ্যবিমা আছে, তাদের পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে তারা সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ফলে তাদের স্বাস্থ্য অপেক্ষাকৃত উন্নত। তাদের ক্ষেত্রে শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু ও বয়োবৃদ্ধের মৃত্যুহার কম।

নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী পরিবারের বিশেষ গণ স্বাস্থ্যবিমা

গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে রিকশাচালক, ভ্যানচালক, ফেরিওয়ালা ও ফুটপাতের ছোট দোকানদার পরিবারের জন্য ২০২১ সালের জুন থেকে মাসিক ২০০ টাকা প্রিমিয়ামে বিশেষ গণ স্বাস্থ্যবিমা চালু করা হয়েছে। বিশেষ গণ স্বাস্থ্যবিমা গ্রহণকারী পরিবারের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। ১০ হাজার শ্রমজীবী পরিবার বিশেষ স্বাস্থ্যবিমা গ্রহণ করলে প্রকল্পটি প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। নতুবা এই প্রকল্পকে আর্থিক সহায়তা ও ভর্তুকি দিয়ে চালু রাখতে হবে।

শ্রমজীবী পরিবার বিশেষ গণ স্বাস্থ্যবিমা অন্তর্ভুক্ত হলে কতকগুলো বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। বিশেষ গণ স্বাস্থ্যবিমা গ্রহীতা পরিবারে রিকশাচালক, ভ্যানচালক, ফেরিওয়ালা, ফুটপাতের ছোট দোকানদার এবং তাদের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও বয়োবৃদ্ধ বাবা-মা গণ স্বাস্থ্যবিমার অন্তর্ভুক্ত হন। তাদের এনআইডি কার্ডের মতো গলায় ঝোলানো পরিচয়পত্র এবং একটি বিশেষ গণ স্বাস্থ্যবিমা বই দেয়া হয়। তাদের ধূমপান ও পান সেবন থেকে নিবৃত্ত থাকার জন্য এবং ছেলেমেয়েদের নিয়মিত স্কুলে পাঠানোর জন্য প্রচেষ্টা চালানো হয়।

অর্থ সঞ্চয় করে চালকরা যেন বাহনের মালিক হতে পারেন, সেজন্য গণস্বাস্থ্য ক্রেডিট সমবায়ে টাকা জমা রাখার ব্যবস্থা আছে। দৈনিক ৫০ টাকা জমা করে একজন রিকশাচালক ছয় মাসে একটি রিকশার মালিক হওয়ার জন্য তার জমানো ৯ হাজার টাকা এবং ব্যাংক থেকে ১৫ হাজার টাকা ধার নিয়ে রিকশা-ভ্যান কিনতে পারবেন। পরবর্তী সময়ে রিকশাচালক এক বছরে ব্যাংকের ধার পরিশোধ করবেন। নিজে রিকশা-ভ্যান মালিক হওয়ায় তাকে গ্যারেজ মালিককে রিকশার ভাড়া বাবদ প্রতিদিন রিকশা ভাড়া বাবদ ১০০ টাকা দিতে হয় না। বাহনের মালিক হওয়ায় রিকশা চালানো অত্যন্ত কায়িক পরিশ্রমের কাজ। তাকে শক্তি অর্জনের জন্য দিনে কয়েকবার খেতে হয়। রিকশাচালক, হকার ও ছোট দোকানদারদের প্রতিদিন একটা নির্ধারিত চাঁদা পুলিশ ও স্থানীয় মাস্তানদের দিতে হয়। ধূমপান ও পান সেবনে তাদের অনেক ব্যয় হয়। পরিবারের পুষ্টির উন্নতি হয়। ঋণ পরিশোধের পরও দৈনিক ১০০ টাকা সঞ্চয় অব্যাহত রাখে, যাতে ভবিষ্যতে তাদের সন্তানরা গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগ পায়।

বিশেষ গণ স্বাস্থ্যবিমার প্রাপ্ত চিকিৎসা সুবিধাসমূহ

১. বিনা ফি ও অতিরিক্ত চার্জ ব্যতিরেকে ১৫ প্রকার স্বাস্থ্য সুবিধা

* গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকের পরামর্শ। * গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে বেড ভাড়া ছাড়া ভর্তি সুবিধা। * হাসপাতালে ভর্তি রোগীকে অক্সিজেনের চার্জ দিতে হয় না। * হাসপাতালে বহির্বিভাগ ও অন্তর্বিভাগে নিখরচায় রোগী সুপেয় পরিশোধিত পানি পেয়ে থাকেন। বাইরে থেকে বোতলের পানি আনতে হয় না। * চক্ষু, কান, দাঁত পরীক্ষা। * ওজন নেয়া ও রক্তচাপ নির্ণয়। * হাত ও পায়ের নখ কাটা। * ইমার্জেন্সি বিভাগে আগুনে পোড়া ও দুর্ঘটনাকবলিত রোগীর পরামর্শ ও চিকিৎসা। * মাসিক নিয়মিতকরণ (Menstrual Regulation) ছাড়া অন্য সব পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির সুবিধা। * শিশুদের মুসলমানি (Circumcision) * গর্ভবর্তীদের প্রসব-পূর্ব ও প্রসব-পরবর্তী সেবা। * ফ্রি রক্ত পরিসঞ্চালন (Blood Transfusion) সুবিধা, কিন্তু রক্তের ব্যাগের মূল্য দিতে হয়। * সপ্তাহে দুই দিন স্থানীয় পর্যায়ে শিশু, গর্ভবতী ও বয়োবৃদ্ধ মানুষের জন্য ক্লিনিকে ফ্রি পরামর্শ।

অল্প খরচে প্রয়োজনীয় বহু পরীক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধা

 * ১০ টাকায় বহুমূত্র রোগের (র‌্যান্ডম ব্লাড সুগার পরীক্ষা)। * ব্যথা নিরাময়ের জন্য প্রতিবার ফিজিওথেরাপি সেবা বাবদ চার্জ হয় মাত্র ২৫ টাকা। * ২৫ টাকায় পাবেন পায়খানা ও প্রস্রাব পরীক্ষা। * রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা ও রক্তের ক্রস ম্যাচিংয়ের জন্যও ২৫ টাকা চার্জ করা হয়। * ৫০ টাকায় পাবেন রক্তের সাধারণ পরীক্ষাসমূহ; ইএসআর, প্লাটিলেট, ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু পরীক্ষা।

* ১০০ টাকায় পাবেন বিশেষজ্ঞ পরামর্শ। * ইসিজি পরীক্ষা। * হƒদরোগ নির্ণয়ের ট্রপোনিন ও রিউমাটয়েড ফ্যাক্টর পরীক্ষা। * মাসিক নিয়মিতকরণ (মিনস্ট্র–য়াল রেগুলেশন) করাতে পারবেন মাত্র ১০০ টাকায়। * ২০০ টাকায় আলট্রাসনোগ্রাফি ও ইকোকার্ডিওলজি পরীক্ষা। * লিভার ফাংশন টেস্টসমূহ। * বিকল কিডনির পরীক্ষাসমূহ। * সিরাম ইলেট্রলাইটস পরীক্ষা। * লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা। * মাইক্রোবায়োলজি। * হিস্টোপ্যাথলজির প্রতি পরীক্ষার জন্য প্রতিবার চার্জ হবে ২৫০ টাকা।

৫. এক্স-রে পরীক্ষা হবে ৪০০ টাকায়, ৭০০ টাকায় কভিড-১৯ (আরটি-পিসিআর) পরীক্ষা।

৬. অন্য সব পরীক্ষা সরকার-নির্ধারিত দরের ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্টে পাবেন।

৭. ২০ শতাংশ ডিসকাউন্টে পুষ্টিকর খাদ্য ‘মিনাভিট’ কমপ্লেক্স সিরাপ ও সব ওষুধ কিনতে পারবেন।

৮. গর্ভবতীর সেবা ও প্রসব ৫০০ টাকায়, তিন হাজার টাকায় সিজারিয়ান অপারেশন সুবিধা এবং চার হাজার টাকায় পাবেন গর্ভথলি বেরিয়ে যাওয়া (প্রলাপস ইউরেটাস) নিরাময় অপারেশন।

১০. বিনা সিট ভাড়ায় আইসিইউ ও কভিড ওয়ার্ডে ভর্তি এবং ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্টে রোগী পরীক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধা।

১১. ৫০০ টাকায় প্রতিবার বিকল কিডনি রোগের চিকিৎসা হেমোডায়ালাইসিস করাতে পারবেন। তবে আর্টিওভেনাস ফিস্টুলা করাতে চার হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ হবে।

১২. এক হাজার টাকায় ছানি কেটে নতুন লেন্স (আইওএল) বসানো হয় এবং তিন হাজার টাকায় চোখের ফেকো অপারেশন সুবিধা।

১৩. পাঁচ হাজার টাকায় সব ইমার্জেন্সি অপারেশন, ভাঙা হাড় জোড়া লাগানো।

১৪. ১০ হাজার টাকায় বড় ভাঙা হাড় জোড়া লাগানো এবং সন্ধি (জয়েন্ট) বদলাতে হলে রোগীকে ইমপ্লান্ট খরচ বহন করতে হয়।

১৫. নিউরোসার্জারি, কার্ডিয়াক সার্জারি প্রভৃতির খরচ ৫০ হাজার টাকা এবং কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট এক লাখ টাকা।

১৬. বিশেষ গণ স্বাস্থ্যবিমার মাসিক প্রিমিয়াম ২০০ টাকা নিয়মিত পরিশোধ না করলে উল্লেখিত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন এবং সরকার-নির্ধারিত নিয়মিত চার্জ হবে। তাতে রোগীর খরচ হবে কমপক্ষে চারগুণ বেশি।

বিশেষ স্বাস্থ্যবিমার জন্য নির্ধারিত প্রয়োজনীয় জনবল

* চারজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তরুণ চিকিৎসক, একজন দন্ত চিকিৎসক, একজন ফিজিওথেরাপিস্ট, ১৪ জন স্বাস্থ্যকর্মী, ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট, প্যাথলজি টেকনিশিয়ান, হিসাবরক্ষক ও জনসংযোগ কর্মী, নিরাপত্তা প্রহরী এবং দুজন ড্রাইভার।

২. ওষুধ, প্যাথলজি পরীক্ষা ও  যানবাহনের জন্য একটি মাইক্রোবাস।

বিশেষ গণ স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্পকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার

জন্য করণীয়

১. নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী ১০ হাজার পরিবারকে এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এজন্য ব্যাপক স্থানীয় প্রচারণা ও সরকারের সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন হবে।

২. সরকারি সাহায্য ও অনুদানে স্থানীয় পর্যায়ে শিশু, গর্ভবতী ও বয়োবৃদ্ধদের সাপ্তাহিক ক্লিনিকের জন্য আড়াই হাজার বর্গফুটের ক্লিনিকের ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। বিদ্যুৎ, শৌচাগার ও পানির ব্যবস্থা থাকতে হবে। ক্লিনিকে ফার্মেসি, মৌলিক প্যাথলজি পরীক্ষা, অ্যাকসিডেন্ট ও পোড়া রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকতে হবে। স্থানীয় জনগণ, সমাজসেবী, রাজনৈতিক কর্মী ও ব্যবসায়ীদের সাহায্য ও অনুদান অত্যাবশ্যক।

৩. আগামী পাঁচ বছরে স্থানীয় ক্লিনিকগুলো পরিণত হবে জেনারেল প্র্যাকটিশনার্স (জিপি) ক্লিনিকে। এজন্য স্থানীয় সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। স্থানীয় ক্লিনিক থেকে রোগীদের প্রয়োজনমাফিক বড় সরকারি হাসপাতালে রেফার করা হবে। অবস্থাপন্ন ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের সাহায্য-সহযোগিতায় ঢাকা শহরে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা সৃষ্টি হবে।

৫. মধ্যবিত্ত ও অবস্থাপন্নরা অতিরিক্ত পরামর্শ ফি’র বিনিময়ে ক্লিনিকের সব সুবিধা পাবেন। সবার সেবার কাজটি কঠিন নয়, তবে আপনার সহযোগিতা প্রয়োজন রয়েছে সফলতা অর্জনের জন্য।

দেশব্যাপী সামাজিক স্বাস্থ্যবিমার প্রচলনের জন্য প্রয়োজন হবে পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল এবং স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নিরাপত্তা বেষ্টনী, গভীর নলকূপের সংস্কার ও সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ।

দ্বিতীয়ত, সরকারি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা হাসপাতালে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক, ডেন্টিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট, ফার্মাসিস্ট ও টেকনিশিয়ান নার্সদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। এসব কর্মীর নিয়োগ হবে স্থানীয় পর্যায়ে, ঢাকা থেকে নয়। স্থানীয়ভাবে পরিবার নিয়ে ইউনিয়ন ও উপজেলার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কমপক্ষে দুই বছর অবস্থান করে জনসাধারণকে চিকিৎসা সেবা না দিলে কোনো চিকিৎসক উচ্চশিক্ষার সুবিধা পাবেন না। দুই বছর পর, রোগ নির্ণয় প্যাথলজি, এক্সরে, আলট্রাসনোগ্রাফি, অ্যানেসথেসিয়া, ইন্টারনাল মেডিসিন, কার্ডিওলজি, নেফ্রোলজি, অর্থোপেডিকস, জেনারেল সার্জারি, গাইনি অবসটেট্রিকস, নাক-কান-গলা, চক্ষু, শিশু ও নবজাতক, চর্মরোগ, মানসিক রোগ, মেডিকেল প্রশাসন প্রভৃতি বিষয়ে ছয় মাস কোর্স করে পরীক্ষা পাস করে সার্টিফাইড বিশেষজ্ঞ হিসেবে উন্নীত হবেন। এসব পদধারী মাসিক ৫০ হাজার টাকা অতিরিক্ত ভাতা পাবেন। মেডিকেল ও প্যারামেডিকেল ছাত্রদের ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষাদানের জন্য মাসিক ২৫ হাজার টাকা অধ্যাপনা ভাতা পাবেন, বিনা ভাড়ায় বাসস্থান সুবিধাও পাবেন।

পরবর্তী সাত বছরে এসব চিকিৎসক যাতে এমএস, এমডি, এমফিল, এফসিপিএস প্রভৃতি শিক্ষাও নিতে পারেন, তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। এসব ডিগ্রি ডিপ্লোমা প্রশিক্ষণ পরীক্ষা দিয়ে অর্জন করলে তারা ‘বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং ন্যূনতম এক লাখ টাকা বিশেষজ্ঞ ভাতা পাবেন। তারা সিনিয়র প্রভাষক, সহ-অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক প্রভৃতি পদের সুবিধা দিলে ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসকরা নিবেদিতভাবে সাধারণ মানুষকে সেবা দিতে আগ্রহী হবেন।

ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের নিরাপত্তা বেষ্টনী, গভীর নলকূপ ও বিদ্যুতের নিশ্চয়তাসহ ন্যূনতম ১০টি পরিবার বাসস্থান, ছাত্রদের জন্য ডরমিটরি ও ল্যাবরেটরি, বহির্বিভাগ, এক্সরে, আলট্রাসনো বিভাগ, ৩০ শয্যার অন্তর্বিভাগ ও অপারেশন থিয়েটারের সম্প্রসারণ এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি সজ্জিত করার জন্য ১০ কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। এর ফলে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র বিলেতের স্থানীয় আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে পরিণত হবে। ফলে চিকিৎসকরা এই পর্যায়ে সেবা দিয়ে আনন্দ পাবেন। বাংলাদেশে ওষুধের সমস্যা নেই। সিনিয়র বিশেষজ্ঞদের প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করে বিকালে তিন-চার ঘণ্টা প্রাইভেট প্র্যাকটিস সুবিধা বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রতি বছর মেডিকেল কলেজগুলোয় ২০ হাজার ছাত্র ভর্তি না করলে সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা চালু করা সম্ভব হবে না। এজন্য সারাদেশে পাঁচ লাখ চিকিৎসকের প্রয়োজন হবে।

স্মরণ রাখা প্রয়োজন, সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা যুগের দাবি এবং আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অত্যাবশ্যক অঙ্গ।

তথ্যসূত্র

১. হোসেন জিল্লুর রহমান, ‘ক্রাইসিস অ্যান্ড ইনসিকিউরিটি: দি আদার ফেইজ অব পোভার্টি ইন রিথিংকিং রুরাল পোভার্টি’ সেজ, নিউ দিল্লি ১৯৯৫

২. বিনায়ক সেন, ‘ড্রাইভার্স অব এসকেইফ অ্যান্ড ডিসেন্ট: চ্যালেঞ্জিং হাউসহোল্ড পোভার্টি ইন রুরাল বাংলাদেশ’ ওয়ান্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ভলিউম ৩১, নম্বর-৩, এলসিভিয়র সায়েন্স, ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য ২০০৩

৩. জিম ইয়ং কিম, জেভি মুলেন, এআরউইন ও জে গারসম্যান, ডাইয়িং ফর গ্রোথ: গ্লোবাল ইনইকুইলিটি অ্যান্ড হেলথ ফর দি পুওর, কমন কারেজ প্রেস, মুনরো, মেইন, যুক্তরাষ্ট্র, ২০০০

৪. স্যার এডউইন চ্যাডউইক, রিপোর্ট অন দ্য স্যানিটারি কন্ডিশন অব দ্য ল্যাবোরিং পপুলেশন অব গ্রেট ব্রিটেন, রয়েল কমিশন, লন্ডন ১৮৪২

৫. চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি স্বাস্থ্যসেবার বড় সমস্যা, দৈনিক সমকাল, ৪ জুলাই ২০১৩

৬. ডক্টরস ব্লেইম ম্যানেজমেন্ট, মিনিস্টার ব্লেইম ডক্টরস, দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন, ৪ জুলাই ২০১৩

ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র