Print Date & Time : 11 September 2025 Thursday 5:31 am

‘দিনের বেলায়ও দরজা জানলা খুলতে মানা’

আরিফুল ইসলাম, ধামরাই (ঢাকা): ঢাকার ধামরাই উপজেলার সুতিপাড়া থেকে সূয়াপুর এলাকায় চলাচলের সড়কের পাশে ধাইরা উত্তরপাড়া এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন মহির উদ্দিন। দিন ও রাতে কখনোই তারা ঘরের জানালা খুলেন না। ওই সড়ক দিয়ে দিনরাত চলাচলকারী ইটভাটার মাটি বহনকারী ট্রাক থেকে সড়কে পড়া মাটি ও মাটি ভর্তি ট্রাকের কারণে সড়কে খানাখন্দ তৈরি হয়ে সেখান থেকে সৃষ্টি হচ্ছে ধুলা। পরে যানবাহন চলাচলের সময় বাতাসে তা উড়ে ঘরে যাওয়ায় এমনটি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। শুধু মহির উদ্দিনের পরিবারই নন, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিয়তই ধুলায় নানা ধরনের ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন স্থানীয়সহ পথচারীরা।

মহির উদ্দিনের স্ত্রী অভিযোগ করে বলেন, ‘জানলা তো খুলিই না। তারপরও দরজা ও ঘরের বিভিন্ন ফাঁকা জায়গা দিয়া ধুলা ঘরে যায়। একটু পরপরই ঝাড়ু দিয়া ধুলা ফালাই। বিছানার ওপর ধুলা, খাইতে বসলে ভাতের ওপর ধুলা পরে ভাত কিচকিচ করে।’

জানা যায়, ধামরাইয়ের ঢুলিভিটা থেকে ফোর্ডনগর, জয়পুরা থেকে জলসিং, সূতিপাড়া থেকে নান্নার, জয়পুরা থেকে দেপাশাই সড়কের বিভিন্ন স্থানে খানাখন্দে ভরা। এসব সড়কের বিভিন্ন স্থানে কার্পেটিং উঠে যাওয়ায় যানবাহন চলাচলের সময় চাকার আঘাতে সড়কের নিচের খোয়াগুলো গুঁড়া হয়ে প্রতিনিয়তই তৈরি হচ্ছে ধুলা।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব সড়কে ইটভাটার জন্য মাটি ভর্তি শতাধিক ট্রাক, ড্রাম ট্রাক, মাহেন্দ্র, দিনরাত ২৪ ঘণ্টা চলাচল করে। এ যানবাহন চলাচলের কারণে সড়কের বিভিন্ন স্থানে কার্পেটিং উঠে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে।

দেপাশাই গ্রামের বাসিন্দা মো. শরিফ উদ্দিন বলেন, ‘দিনরাত মাটির ট্রাকগুলা চলাচলের কারণে রাস্তার বারোটা বেজে গেছে। সড়কের পিচ তো কবেই উঠে গেছে এখন ট্রাকের চাকায় নিচের ইট গুঁড়া হয়ে যাচ্ছে। রাস্তার পাশ দিয়া চলার সময় ইটের গুঁড়া আর মাটির ধুলায় চেহারাই পাল্টে যায়।’

সম্প্রতি ধামরাইয়ের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার বৈধ ও অবৈধ মিলে দেড় শতাধিক ইট ভাটার ইট প্রস্তুতের কাজ চলছে পুরোদমে। অবৈধভাবে লোকালয়, ফসলি জমিসহ অন্যান্য স্থানে গড়ে ওঠা এসব ভাটায় ট্রাকে করে সড়ক দিয়ে প্রতিনিয়তই ইট বানাতে নেয়া হচ্ছে মাটি। সড়কগুলোর অধিকাংশের পার্শ্ববর্তী বাড়িঘর, ফসলি জমির ওপর পড়েছে লালচে ধুলার আস্তরণ। ধুলা থেকে রক্ষা পেতে সড়কের পাশে মুদি ও খাবার দোকানগুলোর সামনে কাপড় দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছে। সবুজ গাছপালার পাতা, ডাল পালায় পড়েছে লালচে ধুলার আস্তরণ।

জলসিং এলাকার বাসিন্দা কৃষক দৌর উদ্দিন বলেন, ‘কারে কী কমু। কে শুনবো আমাগো কথা। খেতে ভুট্টা বুনছি। ভুট্টা গাছে এখন ধুলায় ভরা। মাটির ট্রাক আমাগো সর্বনাশ কইরা দেয়। প্রতি বছরই এই সময়ে এমন হয়। কেউ কিছু কওয়ার সাহস পায় না।’

উপজেলার কাওয়ালীপাড়া থেকে বালিয়া পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন স্থানে সড়কের পাশেই দেখা মেলে ১০-১২ ফুট উঁচু মাটির ডিবি। মাঝে মাঝে মাটি সড়কের কিছু অংশ দখল করেও রাখা হয়। একই চিত্র দেখা যায়, শ্রীরামপুর থেকে সূয়াপুর বাজার, শাসন এলাকার সড়কগুলোর পাশে। এ ডিবির মাটি থেকে তৈরি ধুলা বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া বৃষ্টি হলে মাটি গড়িয়ে সড়কে গিয়ে কাঁদার তৈরি হয়। এতে ভয়ংকর হয়ে উঠে সড়ক। 

ধুলার কারণে প্রতিনিয়তই ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে স্থানীয়দের। এছাড়া সড়কে চলাচলকারী স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, কর্মজীবী নারী-পুরুষ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে এ ভোগান্তিতে রয়েছে চাপা ক্ষোভ।

কাওয়ালীপাড়া এলাকার প্রিন্সিপাল হাফিজ উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র শহীদুল ইসলাম প্রতিদিন স্কুলে যান সাইকেল চালিয়ে। তিনি বলেন, ‘স্কুল ড্রেস এক দিনের বেশি পরা যায় না। ছুটির পর বাড়ি গিয়ে আগে চুল শ্যাম্পু করতে হয়। ধুলায় মাথার চুল, জামা কাপড় সব নষ্ট হয়ে যায়। ’

উপজেলার মাদারপুর থেকে প্রতিদিন সাভারে মোটরসাইকেল নিয়ে অফিস করেন সোহেল রানা। তিনি বলেন, ‘বছরের এই সময়টায় ইটভাটার মাটির ট্রাকের কারণে রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় মাটির আস্তরণ পড়ে রাস্তা ভয়ংকর হয়ে ওঠে। ধুলার কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হয় পাশাপাশি বৃষ্টি হলে কাদা মাটিতে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে যায়। তখন প্রায়ই দ–র্ঘটনা ঘটে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি সালেহ আহাম্মদ খান বলেন, ‘গাছপালা ও ফসলের ওপর ধুলাবালুর আস্তরণ পড়লে এতে উদ্ভিদের সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। স্বাভাবিকভাবেই এতে ফসলের উৎপাদন কমার পাশাপাশি গাছপালার ক্ষতি হয়।’

ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নূর রিফফাত আরা বলেন, ‘বালুর চেয়ে সড়কের খোয়াগুলো গুড়ো হয়ে যে ধুলা তৈরি হচ্ছে তাতে নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ওই ধুলার কারণে হাসপাতালে শ্বাসকষ্টজটিত সমস্যা নিয়ে রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। ছোট বাচ্চাদের ঠাণ্ডাজনিত ফুসফুসের ইনফেকশন হচ্ছে। এছাড়া ১ বছরের নিচে শিশুদের ধুলায় নেজাল ব্লকেজের কারণে (নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া) খাবার গ্রহণে অনীহা সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আনা হচ্ছে।’

ধামরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হোসাইন মোহাম্মদ হাই জকী বলেন, ‘অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। বৈধ ইটভাটার কার্যক্রম পরিচালনার সময় যেকোনো জন দুর্ভোগ তৈরি না হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদের কার্যক্রমে কেউ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হন তবে অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’