দুই মাস পর ফের রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থামছে না। দুই মাস পর আবারও রিজার্ভ কমে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। এর আগে গত নভেম্বরের শুরুতে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছিল। গত বুধবার শেষে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলারে। আগের দিন ছিল ২০ বিলিয়নের ওপরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

মূলত এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল পরিশোধ ও সরকারের বিভিন্ন আমদানি পণ্যের জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার সহায়তা দেয়ার কারণে রিজার্ভের ধারাবাহিক পতন হচ্ছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৩১ জানুয়ারি শেষে বিপিএম-৬ অনুযায়ী গ্রস আন্তর্জাতিক রিজার্ভ (জিআইআর) স্থিতি ছিল ১৯ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার; যা এক মাস আগে অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বরে ছিল ২১ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার। এক মাসে রিজার্ভ কমেছে ১ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার। নভেম্বর শেষে রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবে গত ৩১ জানুয়ারি শেষে রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলার। ডিসেম্বর শেষে ছিল ২৭ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। নভেম্বর শেষে ছিল ২৪ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার।

দেশে দেড় বছর ধরে ডলার-সংকট চলছে। এই সংকটের কারণে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ টাকা হয়েছে। তবে বাজারে লেনদেন হচ্ছে ১২০ টাকার বেশি দামে। এর প্রভাবে চলতি হিসাবের পাশাপাশি আর্থিক হিসাবও এখন ঘাটতিতে রয়েছে। ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার (৪৮ বিলিয়ন)। এর পর থেকে রিজার্ভ ক্রমাগত কমছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেই সময়ের তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অর্ধেকের বেশি কমেছে।

ডলার সংকট এখনও পুরোপুরি না কাটার কারণে রিজার্ভ থেকে ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রি করে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। গত অর্থবছরে বিক্রি করা হয় ১৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়। তবে চলতি অর্থবছরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রিজার্ভ রাখতে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ডলার কেনা শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ১ বিলিয়ন ডলারের মতো কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ডলার বিক্রির কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে প্রচুর টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে উঠে এসেছে। এতে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। তারল্য সংকটের বিষয়ে মুদ্রানীতি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, তারল্য সংকটের মূল কারণ হচ্ছে আমাদের ডলার আসা কমে গেছে। নিট বৈদেশিক মুদ্রা যখন আসে তখন ইকনোমিতে টাকা ঢুকানো হয়। যখন ডলার আসা কমে গেছে তখন উল্টো টাকা তুলে নিচ্ছি। এসব টাকা এখনও বাজারে ছাড়তে পারিনি। যার কারণে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট বেড়েছে। আবার সরকারকে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ দেয়া বন্ধ করেছে। সরকার এখন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে শোধ করছে। এ কারণেও সংকট দেখা দিয়েছে। আমরা এসব সংকট মেটানোর চেষ্টা করছি। আশা করছি, শিগগির তা সমাধান হয়ে যাবে।

তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে সুবিধা দিতে কারেন্সি সোয়াপের দিকে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, লিকুইডিটি ম্যানেজমেন্টে বাংলাদেশ ব্যাংক কারেন্সি সোয়াপের দিকে যাচ্ছে। কারণ এখন অনেক ব্যাংকের কাছে ফরেন কারেন্সি হোল্ডিং বেশি রয়েছে। কিন্তু তার কাছে নগদ টাকা নেই। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে নগদ টাকার সংকট মেটাতে ডলার বিক্রি করে দিতে হয়। আবার ডলার বিক্রি করে দিলেও তার রিস্ক থাকে। কারণ তার পরবর্তী পেমেন্ট দিতে গিয়ে ডলার পাওয়া নিয়ে শঙ্কা থাকে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে একটি কারেন্সি সোয়াপ ফ্রেমওয়ার্কের দিকে যাচ্ছে। যাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ডলার রেখে টাকা নিতে পারেন। আবার যখন প্রয়োজন হবে টাকা দিয়ে ডলার নেবে।

জানা যায়, এ পদ্ধতিতে ব্যাংকগুলো ১ থেকে ৩ মাস পর্যন্ত ডলার রেখে টাকা নিতে পারবে। সর্বনিম্ন ৫ মিলিয়ন ডলার রাখার সুযোগ থাকবে। এর মাধ্যমে ডলার ও টাকার সংকট কিছুটা কমে আসবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন।

এদিকে ডলার-সংকট, আমদানিতে নিয়ন্ত্রণের কারণে ব্যাংকে এখন ঋণপত্র (এলসি) খোলা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার কারণে গত অর্থবছরের পর এবারও আমদানি কমছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য এলসি নিষ্পত্তি ১৮ শতাংশের বেশি কমে ৩ হাজার ৩৬৮ কোটি ডলারে নেমেছে। সবচেয়ে বেশি কমেছে শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি। ডিসেম্বর পর্যন্ত শিল্পের কাঁচামালের এলসি ৩১

শতাংশের বেশি কমে ১ হাজার ৫৪ কোটি ডলারে নেমেছে। মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তি প্রায় ২৭ শতাংশ কমে ১৪৩ কোটি ডলারে নেমেছে। গত অর্থবছরে আমদানি ১৬ শতাংশের মতো কমে ৬ হাজার ৯৫০ কোটি ডলারে নেমেছিল। এর মধ্যে মূলধনি পণ্যের আমদানি ২৪ শতাংশের বেশি এবং মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি প্রায় ২২ শতাংশ কমেছিল। একটি দেশের উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়ছে কি না, তা বোঝার সহজ উপায় বিবেচনা করা হয় মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পে ব্যবহারিত কাঁচামাল আমদানি কেমন হচ্ছে, তার ওপর। সাম্প্রতিক সময়ে বিলাসী পণ্যের চেয়ে এ দুটি পণ্যের আমদানি কমছে বেশি হারে।

এতদিন ডলারের জোগান-চাদিহার মাধ্যমে ডলারের দর ওঠানামা করত। তবে এই পদ্ধতিতে ডলার বাজার স্থিতিশীল করতে না পারায় ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ উপায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের একটি মধ্যবর্তী দর ঠিক করবে। তার সঙ্গে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি ও হ্রাসের একটি শতাংশ নির্ধারণ করা হবে। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি অনুষ্ঠানে ‘ক্রলিং পেগ’ চালুর ঘোষণা দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।