মাহমুদুল হক আনসারী: দুর্নীতিবাজদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া যায় না। তারা দেশ ও জাতির শত্রু, স্বাধীন রাষ্ট্রের দুশমন। দুর্নীতি করে যারা স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সেক্টরে বহাল থেকে সম্পদের পাহাড় তৈরি করেছে, তাদের রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে খুঁজে বের করে আনতে হবে। দুর্নীতির মাধ্যমে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ অর্জন নতুন কোনো বিষয় নয়। স্বাধীনতার পর থেকে কম-বেশি সব সরকারের সময় দুর্নীতিবাজরা ওত পেতে ছিল। সময় ও সুযোগ বুঝে তারা দেশের সম্পদ ও অর্থ লুণ্ঠন করেছে, আর অর্থ পাচার করেছে। এ সংস্কৃতি থেকে দেশের জনগণ মুক্তি পাচ্ছে না। সরকারের বড় বড় দায়িত্বে অধিষ্ঠিত থেকে একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এসব দুর্নীতি সংঘটিত করছে। তারা অর্থ পাচার করেছে। বহির্বিশ্বে টাকা পাচারের মাধ্যমে ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। বাড়িঘর তৈরি করছে। সন্তানদের বিদেশের মাটিতে পড়ালেখার সঙ্গে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করে রাখছে। তাদের পাচারকৃত অর্থ হাজার হাজার কোটি টাকা, যা বিভিন্ন সময়ে জাতীয় প্রথম সারির দৈনিকে তথ্যসহ প্রকাশিত হয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত সব সরকারের সময় দুর্নীতিবাজরা এভাবে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শক্তিকে ধ্বংস করে আসছে। অপরাধ সংঘটিত করার পর রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আসে, চোর পালিয়ে গেলে বুদ্ধি বাড়ে। এ সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলাদেশ এখন একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বেঁচে আছে। আমাদের স্বাধীনতার পর পৃথিবীর বহু দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আজকে সেসব দেশ মাথা উঁচু করে অর্থনীতিতে সফলভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের অর্থনৈতিক ভিত অত্যন্ত মজবুত। ব্যবসা-বাণিজ্যে সেসব দেশ পৃথিবীর উন্নত দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগিতায় দাঁড়িয়ে আছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ অনেক পিছিয়ে পড়ে আছে। আমাদের জাতীয় অর্থনীতি এখনও অনেক ক্ষেত্রে নড়েবড়ে। ঋণের ওপর ভরসা করে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতির চালিকাশক্তি অব্যাহত আছে। আজকের জš§ নেয়া শিশুর মাথায় পর্যন্ত বিশাল আকারের ঋণের বোঝা। ঋণের ওপর ভরসা রেখে বাংলাদেশের অর্থনীতি চলমান। বাংলাদেশ সরকারের ক্ষমতায় এ পর্যন্ত যারাই ছিল সবাই বৈদেশিক ঋণপ্রাপ্তিকে রাষ্ট্র পরিচালনায় সফলতা বলে মনে করেছে।
বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের সরকারি ও বেসরকারি অর্থ প্রতিষ্ঠান থেকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ গ্রহণ করেছে সরকার। কী পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, সেটা সাধারণ জনগণ না জানলেও জনগণ আঁচ করতে পেরেছে। ঋণে ঋণে জনগণ থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত সব ক্ষেত্র জর্জরিত। এক সরকার গেলে আরেক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হলে তাকেও এ ঋণ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পরিশোধ করতে হবে। ঋণ কখনও কোনো দেশ বা সংস্থা মাফ করে দেয় না। ঋণ ও সুদ দুটোই শোধ করতে হয়। তাই বলা যায়, বাংলাদেশ ও জনগণ একপ্রকার ঋণের ওপর ভাসছে। এর মধ্যে ঋণের টাকায় উন্নয়নের বরাদ্দ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়, ২০২২ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে বাংলাদেশ থেকে সর্বাধিক অর্থ পাচার হয়েছে। নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বেশ কয়েকটি অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণের মাধ্যমে পাচার করেছে। জনগণ জানে সব অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের ফাদার হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকির বাইরে কোনো ব্যাংকের কার্যক্রম চলে না। বাণিজ্যিক ব্যাংকের যাবতীয় লেনদেনের হিসাব আমার জানামতে, বাংলাদেশ ব্যাংকে অবহিত করতে হয়। কথা হলো, এত নিয়মকানুন থাকার পরেও কতিপয় ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা কীভাবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নামে-বেনামে নিয়ে ফেলল? সেটার দায়িত্ব কে নেবে।
সাধারণ জনগণের আমানত গচ্ছিত আছে এসব ব্যাংকে। বিদেশ থেকে দেশের শ্রমিক ভাইয়েরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রেমিট্যান্সের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠায়। ব্যাংকের মাধ্যমে তারা রেমিট্যান্স পাঠায়। আর সে অর্থে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ব্যাংক থেকে হঠাৎ করে এভাবে প্রচুর পরিমাণে অর্থ তুলে নেয়ার কারণে অনেক ব্যাংক নগদ অর্থের সংকটে পড়েছে। ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে অনেত আমানতকারীই ব্যাংক থেকে তাদের আমানত তুলে ফেলার জোট বেঁধেছে। বাজারে গুজব ছড়িয়ে পড়ছে ব্যাংকে নগদ টাকার সংকট। অনেক অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান আমানতকারীকে যথাসময়ে টাকা দিতে পারেনি। আতঙ্কের কারণে এসব গুজবে অনেক গ্রাহক এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট নিয়ে যাচ্ছে। বড় ধরনের একটি গুজব বর্তমানে সারাদেশে অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান নিয়ে চলছে। এটা দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ধরনের আশঙ্কা ও ক্ষতির সংবাদ। এর ফলে বিদেশ থেকে আমাদের দেশের শ্রমজীবী রেমিট্যান্স যোদ্ধারা সময়মতো অর্থ পাঠানো সংকুচিত করছে। সরকারকে এসব বিষয় অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। এটা একপ্রকার আমাদের সার্বভৌম দেশের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র। দেশ যখন নানাভাবে উন্নয়ন অগ্রগতিতে এগিয়ে চলছে, তখন এ ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতি রাষ্ট্রের জন্য অশনি সংকেত ছাড়া আর কিছু নয়।
যেভাবেই হোক রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট সেক্টরকে দুর্নীতিবাজ অর্থপাচারকারী, সে যত বড়ই শক্তিধর ক্ষমতাশালী হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। জনগণের সম্পদ ও আমানত রক্ষা করতে হবে। দেশের সম্পদ দেশে রাখতে হবে। পাচারকারীকে কোনোভাবেই আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। দুর্নীতিবাজ যে বা যারা এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে কঠোর হতে হবে। বাংলাদেশ যেভাবে হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে উন্নয়নের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে পৌঁছাতে যাচ্ছে, সে সময় অর্থনৈতিক চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র কোনোভাবেই জনগণ মেনে নিতে পারে না। কঠোর হাতে দুর্নীতিবাজ ও অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মানবাধিকার ও জনগণের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের আশ্রিত করার জন্য জনগণের ওপর অন্যায় কোনো ধরনের চাপ অবৈধ। সব ধরনের নাগরিক অধিকারের ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ জনগণের অপরাপর নাগরিক অধিকারগুলো সহজলভ্য করতে হবে।
মুক্ত লেখক
চট্টগ্রাম