Print Date & Time : 13 September 2025 Saturday 12:48 am

দুর্নীতির সর্বগ্রাসী বিস্তার থামাতে হবে

মো. জিল্লুর রহমান: ঘুষ ও দুর্নীতি যেকোনো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির সবচেয়ে বড় শত্রু। বাংলাদেশের দুর্নীতির আওতা ও পরিধি এতটাই ব্যাপক যে, একে কয়েক লাইনের একটি প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করা প্রায় অসম্ভব ও দুরূহ কাজ। ঘুষ ও দুর্নীতি হলো নীতিবিরুদ্ধ একটি ঘৃণিত অপরাধমূলক কাজ। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঘুষ ও দুর্নীতি একটি ভয়াবহ অভিশাপ। যদিও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য দূরীকরণসহ সর্বোপরি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে কঠিনতম অন্তরায় দুর্নীতি, তথাপি দেশের আপামর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তারা দুর্নীতির নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী মাত্র। ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি ও তা প্রতিরোধে ব্যর্থতার কারণে দেশ বা দেশের সমগ্র জনগণকে কোনোভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত বলা যায় না।

সম্প্রতি দুর্নীতিরোধী বেসরকারি সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) দুর্নীতির জাতীয় খানা জরিপ ২০২১-এর একটি উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছে। তাতে বলা হয়েছে, দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এছাড়া শীর্ষ তিনে থাকা অপর দুটি সংস্থা হলো পাসপোর্ট ও বিআরটিএ। এই তিনটি খাতে সবচেয়ে বেশি ঘুষও নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। টিআইবি সেবা খাতে দুর্নীতির ধরন ও মাত্রা নির্ণয়ে ১৯৯৭ সাল থেকে দুর্নীতি-বিষয়ক জাতীয় খানা জরিপ পরিচালনা করে আসছে। এ পর্যন্ত দুই থেকে তিন বছর অন্তর ৯টি খানা জরিপ পরিচালনা করেছে এবং এ খানা জরিপটি এ ধরনের নবম জরিপ। টিআইবি বলছে, ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত ৬৪টি জেলায় জরিপটি পরিচালিত হয়। নির্বাচিত খানাগুলো ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন সেবা খাতে সেবা গ্রহণের সময় যেসব দুর্নীতি ও হয়রানির সম্মুখীন হয়েছে, তার ওপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। টিআইবি ‘খানা’ হিসেবে একই বাসস্থানে বসবাস করে, একই রান্নায় খাওয়া-দাওয়া করে এবং তাদের মধ্যে একজন খানাপ্রধান হিসেবে স্বীকৃত এমন পরিবারকে বিবেচনা করেছে।

জরিপে টিআইবি জানিয়েছে, ২০২১ সালের জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৭০.৯ শতাংশ ‘খানা’ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি খাত বা প্রতিষ্ঠানের সেবা নিতে গিয়ে কোনো না কোনো খাতে দুর্নীতির শিকার হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ৭৪ দশমিক ৪০ শতাংশ সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে; এর পরেই রয়েছে পাসপোর্ট ৭০ দশমিক ৫০ শতাংশ, বিআরটিএ ৬৮ দশমিক ৩০ শতাংশ, বিচারিক সেবা ৫৬ দশমিক ৮০ শতাংশ, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ৪৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ৪৬ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং ভূমি সেবা ৪৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। টিআইবি আরও বলছে, সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায় ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সেবা খাতে দুর্নীতির শিকার খানার হার বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে ২০১৭ সালে ছিল ৬৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ঘুষের শিকার খানার হার হ্রাস পেয়েছে, যেখানে ২০১৭ সালে ছিল ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ, সেটা ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৪০ দশমিক ১০ শতাংশ। জরিপের ফলাফলে আরও দেখা যায়, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, এনজিও, বিমা, ব্যাংকিং এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে দুর্নীতি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে; অন্যদিকে শিক্ষা, বিদ্যুৎ, কৃষি ও গ্যাস খাতে দুর্নীতি কমেছে। এ জরিপে অন্তর্ভুক্ত খাতগুলোয় সেবা পর্যায়ে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূতভাবে লেনদেন হওয়া অর্থের প্রাক্কলিত মোট পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা, যা ২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ৫ দশমিক ৯ শতাংশ এবং জিডিপির শূন্য দশমিক চার শতাংশ।

অন্যদিকে বার্লিন-ভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে দুর্নীতির ধারণাসূচক বা করাপশন পারসেপশনস ইনডেক্স (সিপিআই) ২০২০ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই রিপোর্টে দুর্নীতির বিশ্বজনীন ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা দুই ধাপ পিছিয়েছে। মোট ১৮০টি দেশের তথ্য নিয়ে সংস্থাটি সিপিআই ২০২০ প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ সর্বনি¤œ অবস্থানে এবং দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে একমাত্র আফগানিস্তানই বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। সূচক অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ভুটান, দেশটির স্কোর ৬৮। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় নিচের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। ২০১৯ সালে ছিল ১৪তম। সূচকে উচ্চক্রম (ভালো থেকে খারাপের দিকে) অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এবারও বাংলাদেশ ১৪৬তম অবস্থানে রয়েছে। ১০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ২৬। ১২তম অবস্থানে আরও রয়েছে উজবেকিস্তান ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক।

টিআইবির মতে, বাংলাদেশের দুর্নীতির সম্ভাব্য কারণগুলো হলোÑদুর্নীতির বিরুদ্ধে অঙ্গীকার এবং এর বাস্তবায়নের মিল না থাকা; উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও আমলাদের দুর্নীতি চিহ্নিত না করা; সরকার ও রাজনৈতিক দল-সহ উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে না পারা; আর্থিক ও ব্যাংক খাতে ঋণখেলাপি ও জালিয়াতি বৃদ্ধি পাওয়া; ভূমি-নদী-খালবিল দখল, টেন্ডার ও নিয়োগে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ না কমা; অবৈধ অর্থের লেনদেন বন্ধ না হওয়া; দুর্বল জবাবদিহি; দুদকের কার্যকারিতা ও স্বাধীনতার অভাব; দায়মুক্তি ও দুর্বল আইনের শাসন। অর্থাৎ দুর্নীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং এই অপরাধে সবার জন্য আইন সমান, সেই ধারণা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া এবং গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের ক্ষেত্র সংকুচিত করা।

দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনকারীরা মনে করেন, ‘দুর্নীতির জন্য ৯০ শতাংশ দায়ী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাদের নোংরা রাজনীতি, ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ ও রাতারাতি ধনী হওয়ার আকাক্সক্ষাই দুর্নীতির অন্যতম কারণ। তারা বলেন, দুর্নীতি থেকে উত্তরণের একটি সুচিন্তিত পথ হলো দলবাজি, স্বজনপ্রীতি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের ঠেকিয়ে আয়বৈষম্য কমিয়ে আনা। বাংলাদেশকে ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে গড়তে হলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও আমলাদের সদিচ্ছা শুধু কাগজে-কলমে থাকলে হবে না, বাস্তবে থাকতে হবে। কারণ সব সচেতন দায়িত্বশীল নাগরিকদের সদিচ্ছা ছাড়া কখনও দুর্নীতি দমন সম্ভব হবে না, কোনো দেশেই হয়নি, আমাদের দেশেও হবে না।

দুর্নীতিবাজ মানেই স্বার্থান্ধ, বিবেকবর্জিত। তিনি সবসময় নিজের স্বার্থসিদ্ধির মতলবে থাকেন। স্বার্থান্ধ ব্যক্তি নিজের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার কাজেই ব্যস্ত থাকেন। সমাজের কল্যাণ ও দেশের মঙ্গলের কথা তিনি চিন্তা করেন না। জাতীয় জীবনের উন্নতি, সমৃদ্ধির কথা ভাবতে তার বিবেক সায় দেয় না। এজন্য বিবেকবর্জিত ও দুর্নীতিগ্রস্ত লোক দেশের সব উন্নতির পথে বাধাস্বরূপ, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির বড় শত্রু।

উন্নয়ন কাজকে ত্বরান্বিত করতে যেটি বাধা হয়ে দাড়াচ্ছে, তা হলো দুর্নীতি। নৈতিকভাবে উন্নত, সৎ ও বিবেকবান মানুষ যে পদেই থাকুন কেন, তিনি সমাজ ও জাতির বড় সম্পদ। তাকে দিয়ে উপকার না হলেও অন্তত কারও ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। অপরদিকে নৈতিকতা-বিবর্জিত ব্যক্তি যতই উচ্চ আসনে অবস্থান করুক না কেন, তিনি মোটেও শ্রদ্ধার পাত্র নন। পদমর্যাদার কারণে তাকে হয়তো মানুষ সামনে কিছু বলে না, কিন্তু পেছনে অন্তর থেকে ঘৃণা করে। তার দ্বারা উপকারের চেয়ে দেশ ও জাতির ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি।

দুর্নীতি বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে একটি বড় ব্যাধি। এটি দেশের সার্বিক অগ্রগতি এবং উন্নয়ন ব্যাহত করে চলছে যুগের পর যুগ। দুর্নীতি দমন কোনো সরকারের পক্ষে এককভাবে দমন করা সম্ভব নয়। সরকারের পাশাপাশি সর্বস্তরে মূল্যবোধ সৃষ্টি এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে আমাদের। শুধু সরকার বা রাজনৈতিক দলের নয়, সরকারের পাশাপাশি সর্বস্তরের সচেতন নাগরিকদেরও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। রোগের চিকিৎসার চেয়ে যদি রোগ প্রতিরোধ করা যায়, তাহলে বেশি কাজে দেয়। আমরা যদি আমাদের শুভবুদ্ধি, মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে দুর্নীতির সর্বগ্রাসী বিস্তার ও থাবা প্রতিরোধ করতে না পারি, তাহলেই দুর্নীতি নামক জাতীয় ব্যাধির বিস্তার বাড়তেই থাকবে!

ব্যাংক কর্মকর্তা ও মুক্ত লেখক

ুৎনননঢ়Ñমসধরষ.পড়স