দুর্বল কোম্পানির আইপিওতে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা

মো. সুলাইমান: সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পুঁজিবাজার থেকে তেমন মুনাফা করতে পারেননি বিনিয়োগকারীরা। শেয়ার দরে ব্যাপক পতনের পাশাপাশি সূচক একই জায়গায় আটকে থাকতে দেখা গেছে। পুঁজিবাজারে গত দুই বছরে খুব কম সংখ্যক প্রতিষ্ঠান আইপিওর মাধ্যমে তালিকাভুক্ত হয়েছে, তার মধ্যে বেশির ভাগ কোম্পানির আর্থিক অবস্থা অনেক দুর্বল। দর পতন অব্যাহত থাকায় সেসব কোম্পানির শেয়ারে লাভের মুখ দেখতে পারেনি বিনিয়োগকারীরা। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। একইসঙ্গে কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে রয়েছে শেয়ার কারসাজিসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগ। গত কয়েক বছর আইপিওতে আসা কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তথ্য মতে, সদ্য সমাপ্ত বছরে চারটি কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে তালিকাভুক্ত হয়েছে। কোম্পানিগুলো হলোÑ বেস্ট হোল্ডিংস, এনআরবি ব্যাংক লিমিটেড, এশিয়াটিক ল্যাবরেটিজ এবং টেকনো ড্রাগস। এই চার কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে তুলেছে ৬৪৫ কোটি টাকা। এর আগে ২০২৩ সালেও মাত্র তিনটি কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে তালিকাভুক্ত হয়, যা ছিল প্রায় দুই দশকের মধ্যে সর্বনি¤œ। একই বছর একটি মিউচুয়াল ফান্ডও আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসে। ২০২৩ সালে তালিকাভুক্ত হয়Ñমিডল্যান্ড ব্যাংক, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স এবং সিকদার ইন্স্যুরেন্স। আলোচ্য বছরটিতে তালিকাভুক্ত হওয়া মিউচুয়াল ফান্ডটি হলো- ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ড। ২০২৩ সালে তিন কোম্পানি ও একটি মিউচুয়াল ফান্ড পুঁজিবাজার থেকে মোট তুলে নিয়েছে ২০২ কোটি টাকা।

সাধারণত পুঁজিবাজারে যখন কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে তালিকাভুক্ত হয় তখন বিনিয়োগকারীরা তা থেকে সামান্য কিছু আয় করতে পারেন। তবে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে আইপিওর মাধ্যমে তালিকাভুক্ত হওয়া আট কোম্পানি ও একটি মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ছয়টি বা ৬৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দরে ব্যাপক পতন হয়েছে। এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করে লাভ করাতো দূরের কথা উলটো পুঁজি হারিয়ে বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হয়েছে বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা।


ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, গত দুই বছরে আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিাবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের কিছু দিতে আসেনি। উলটো এসব কোম্পানি শেয়ার কারসাজিকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শেয়ার বিক্রি করে বের হয়ে গেছে। এসব কোম্পানিকে অনুমোদন দেয়াই ঠিক হয়নি। এখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থারও দায় রয়েছে। সুতরাং সচেতন হয়ে বিনয়োগকারীদের নিজেদেরই বাঁচতে হবে। এসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করতে অনেকে আবার মার্জিন নিয়েছে।

সদ্য সমাপ্ত বছরের শেষ ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ১৯ টাকা ৪০ পয়সা বা ৩৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের শেয়ার দর কমেছে ১৭ টাকা ২০ পয়সা বা ৩২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। তবে মিডল্যান্ড ব্যাংকের শেয়ার দর গত ছয় মাসে ১৪ টাকা ৫০ পয়সা বা ৪৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ডের ইউনিট দর কমেছে ৩ টাকা ৮০ পয়সা বা ৩০ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এছাড়া গত জুলাই-ডিসেম্বরে বেস্ট হোল্ডিংসের শেয়ার দর কমেছে ১৪ টাকা ৬০ পয়সা বা ৪৪ দশমিক ৫১ শতাংশ। এছাড়া সিকদার ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ৮ টাকা ৬০ পয়সা বা ২৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ। গত জুলাইয়ে লেনদেন শুরু হওয়া টেকনো ড্রাগসের দর উঠেছিল ৬৩ টাকা ৫০ পয়সায়। এরপর গত আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে এ কোম্পানিটির শেয়ার দর কমেছে ২৭ টাকা ৬০ পয়সা বা ৪৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ। তবে জুলাই-ডিসেম্বরে এনআরবি ব্যাংকের শেয়ার দর বেড়েছে ১ টাকা ৬০ পয়সা বা ১৩ দশমিক ২২ শতংশ। এই চার প্রতিষ্ঠান ২০২৪ সালে আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়।

সোহাগ ভূঁইয়া নামের একজন বিনিয়োগকারী শেয়ার বিজকে বলেন, গত কয়েক বছর ধরে পুঁঁজিবাজারে ব্যাপক অস্থিরতা বিরাজ করছে। শেয়ার কারসাজি ও সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে গুজব বেড়েছে। এতে আমার মতো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে দেয়। আমিও গত দুই বছরে বেশ কয়েকবার লোকসানে পড়ে বাজার ছেড়েছিলাম। আইপিও থেকে খুব সামান্য লাভ করা সম্ভব হয়েছে। সেই কোম্পানিগুলোর অবস্থাও এখন আর ভালো নেই। গত দুই বছর ধরে আইপিওতে আসা কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর কমার পাশাপাশি আয়ও কমেছে। গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে আলোচ্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে সাতটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) কমেছে। এছাড়া ক্যাপিটেক গ্রামীণ মিউচুয়াল ফান্ডেরও ইউনিট প্রতি লোকসান হয়েছে। একই প্রান্তিকে দুটি প্রতিষ্ঠানে নগদ টাকার প্রবাহ বা ক্যাশ ফ্লো কমেছে।

কোম্পানিগুলোর তথ্য বলছে, তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই’২৪-সেপ্টেম্বর’২৪) মিডল্যান্ড ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ছিল ৯ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে ইপিএস হয়েছিল ২২ পয়সা। অর্থাৎ আলোচ্য এই প্রান্তিকে মিডল্যান্ড ব্যাংকের ইপিএস কমেছে ১৩ পয়সা। অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের মুনাফা কমেছে প্রায় ৭৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছে ২৪ পয়সা। গত বছর একই সময়ে ইপিএস হয়েছিল ৯২ পয়সা। এছাড়া প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই’২৪-সেপ্টেম্বর’২৪) ক্যাপিটেক গ্রামীণ মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট প্রতি লোকসান হয়েছে ০১ পয়সা। গত বছর একই সময়ে ইউনিট প্রতি ৭৩ পয়সা লোকসান হয়েছিল। আলোচিত সময়ের ফান্ডের ইউনিট প্রতি নগদ অর্থের প্রবাহ ছিল ঋণাত্মক ৯৯ পয়সা।

এছাড়া প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সমন্বিতভাবে বেস্ট হোল্ডিংসের ইপিএস হয়েছে ১ পয়সা। গত বছর প্রথম প্রান্তিকে ইপিএস হয়েছিল ৩৭ পয়সা। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে কোম্পানিটির ইপিএস কমেছে ৩৬ পয়সা। আলোচ্য প্রান্তিকে কোম্পানিটির ক্যাশ ফ্লো ছিল ২২ পয়সা, যা গত বছর একই সময়ে ৩১ পয়সা ছিল। অর্থাৎ আয় কমার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির নগদ টাকা প্রবাহও কমেছে।
গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে টেকনো ড্রাগসের ইপিএস হয়েছে ৬৩ পয়সা। গত বছর প্রথম প্রান্তিকে ইপিএস হয়েছিল ১ টাকা ৯ পয়সা। একই প্রান্তিকে কোম্পানিটির ক্যাশ ফ্লো ছিল ২৩ পয়সা, যা এর আগের বছর একই সময়ে ১ টাকা ৫১ পয়সা ছিল। অর্থাৎ কোম্পানিটির ইপিএস ও নগদ টাকার প্রবাহ দুটোই কমেছে। এছাড়া সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে এনআরবি ব্যাংকেরও সমন্বিত ইপিএস কমেছে ৭৪ পয়সা। তবে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও সিকদার ইন্স্যুরেন্সের ইপিএস নামমাত্র বেড়েছে। আলোচ্য এই প্রান্তিকে ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের ছয় পয়সা এবং সিকদার ইন্স্যুরেন্সের ৫ পয়সা ইপিএস বেড়েছে।

সদ্য সমাপ্ত বছরে আইপিও পদ্ধতিতে পুঁজিবাজার থেকে সবচেয়ে বেশি ৩৫০ কোটি টাকা তুলেছিল বেস্ট হোল্ডিং। বেস্ট হোল্ডিংসকে শিবলী কমিশন এই সুযোগ দিলেও রাশেদ মাকসুদের কমিশন গত সেপ্টেম্বরে বেস্ট হোল্ডিংসের আইপিও অনুমোদন ও ইস্যুসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় অনুসন্ধান ও তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়া ওষুধ ও রসায়ন খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের আইপিও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থের ব্যবহার ও বিগত ছয় বছরের আর্থিক প্রতিবেদন খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিএসইসি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময় শেষের দিকে। এ বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বিএসইসির মুখপাত্র রেজাউল করিম জানিয়েছিলেন, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজে কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সদ্য সমাপ্ত বছরজুড়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা ছিল ব্যাপকহারে। এসবের প্রভাব দেশের পুঁজিবাজারেও পড়েছে। বিনিয়োগ করে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেক বিনিয়োগকারী। অনেকে আবার বাজার ছেড়ে চলে গেছেন। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড বাংলাদেশের (সিডিবিএল) তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের শুরুতে পুঁজিবাজারে ১৭ লাখ ৫৬ হাজার ৪৪০ জন নারী ও পুরুষ বিনিয়োগকারী ছিলেন। বছর শেষে বিনিয়োগকারীর সংখ্য কমে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৬৪ হাজার ৭৯৭ জন। অর্থাৎ সদ্য সমাপ্ত বছরে দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী কমেছে ৯১ হাজার ৬৪৩ জন।