‘ফের লোকসানি কোম্পানির শেয়ারে উল্লম্ফন’ শিরোনামে যে খবর প্রকাশ হয়েছে গতকালের শেয়ার বিজে, তা সচেতন পাঠককে চিন্তিত না করে পারে না। আমাদের প্রতিবেদক জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে বেশ গতিশীলতা বিরাজ করলেও কয়েক দিন ধরে দেখা দিয়েছে মন্দাভাব। অবশ্য প্রবণতাটি স্থায়ী হবে না বলে মনে করেন অনেকে। তবে বাজারের ধীরগতি এ সম্পাদকীয়র বিষয়বস্তু নয়। আমরা বরং বিস্মিত এটা লক্ষ করে যে, এ মন্দার মাঝেও একশ্রেণির কোম্পানির শেয়ারদর বৃদ্ধি পাচ্ছে আর সেগুলোর বেশিরভাগই লোকসানি কিংবা দুর্বল মৌলভিত্তিসম্পন্ন। এক্ষেত্রে চিহ্নিতকরণের জন্য নয়, দুর্বল কোম্পানির উল্লম্ফন বোঝার স্বার্থে একটি কোম্পানির কয়েক মাসের শেয়ার-সংক্রান্ত তথ্যাদি তুলে ধরা যেতে পারে। যেমন, ১৩ লাখ ৬৮ হাজার শেয়ারবিশিষ্ট মডার্ন ডায়িংয়ের অনুমোদিত মূলধন তিন কোটি ৫০ লাখ টাকা ও পরিশোধিত মূলধন এক কোটি ৩৬ লাখ টাকা। কোম্পানিটি গত দুবছর ধরে শেয়ারহোল্ডারদের দিয়ে আসছে মাত্র আট শতাংশ লভ্যাংশ (ডিভিডেন্ড); যার প্রকৃত মুনাফার হার তথা ইল্ড মাত্র দশমিক ৭৪ শতাংশ। অথচ মডার্ন ডায়িং কর্তৃক পরিশোধিত এ লভ্যাংশ-চিত্রের সঙ্গে কোম্পানির শেয়ারদরকে মেলানো কঠিন। প্রাপ্ত তথ্যমতে, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে বাড়ছিল প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারদর। সে সময় কোম্পানির শেয়ার বিক্রি হয়েছে ১৫৪ টাকা ৮০ পয়সায়। এটি বাড়তে বাড়তে সর্বোচ্চ ২৮৪ টাকায় উপনীত হয় আগস্টের শেষভাগে। পরে দর কমতে কমতে ১৭৬ টাকায় পৌঁছায়। অতঃপর গত সপ্তাহের দু-তিন দিন উল্লম্ফন দেখা যায় মডার্ন ডায়িংয়ের শেয়ারদরে। এটি নাকি ২০৯ টাকায় বিক্রি হয়েছে বুধবার। বাজারের গতি ও দিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কোনো একটি কোম্পানির শেয়ারের দামে পরিবর্তন আসবে এটা স্বাভাবিক বিষয়। প্রশ্ন হলো, মডার্ন ডায়িংয়ের বেলায় যেটি ঘটেছে, তা স্বাভাবিক কি না। একটি দুর্বল মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম ১৫৫ থেকে ক’মাসের ব্যবধানে ২৮৪ টাকায় উঠে আবার ১৭৬ টাকায় নেমে ২০৯ টাকায় অবস্থান করাটা কী সুস্থ প্রবণতা? কারও কারও মতে, ঘটনাটি কেবল মডার্ন ডায়িং নয়, একশ্রেণির লোকসানি ও দুর্বল মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানি যাদের শেয়ার সীমিত, তাদের বেলায়ই ঘটছে। প্রশ্ন হলো, তা কেন?
খেয়াল করা দরকার, বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছেন বেশ কিছু অসাধু চক্র এখনও সক্রিয় স্থানীয় শেয়ারবাজারে। ২০১০-১১ সালের ধসে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘মার্কেট কারেকশন’ হলেও যেসব চক্র ওই সময় সক্রিয় ছিল বলে কথিত আছে, সেগুলো বহাল তবিয়তে রয়ে যায় মূলত ‘কারসাজির সঙ্গে যুক্ত’দের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গৃহীত না হওয়ায়। অস্বীকার করা যাবে না, বাজারের ওই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কথিত কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ কিছুটা কঠিন ছিল। তবু আমাদের প্রত্যাশা শেয়ারবাজার ধস নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছে, স্বচ্ছতার খাতিরে সেটি অন্তত যেন প্রকাশ করা হয়। সেটিও না করায় একশ্রেণির অসাধু চক্র উৎসাহিত হয়েছে বললে ভুল হবে না। আর সেটা থেকেই তারা যদি দুর্বল মৌলভিত্তিসম্পন্ন একশ্রেণির কোম্পানির শেয়ার নিয়ে খেলতে শুরু করে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এও ঠিক, ২০১০-১১ সাল আর এখনকার পরিস্থিতি এক নয়। ওই সময় যেসব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিবেচনা উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে একরকম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিরাজমান ছিল, সেগুলোও আজ অনেকাংশে তিরোহিত। ফলে চলতি প্রেক্ষাপটে দুর্বল মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারদরে উল্লম্ফনের কারণ অনুসন্ধান শুধু নয়, সেটা অনুসন্ধানপূর্বক কোনো চক্র এতে জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি)।