মো. সেলিম হোসেন : বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রতি বছর কোনো না-কোনো দুর্যোগে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী দুর্যোগের ব্যাপকতা প্রমাণ করে দুর্যোগের পূর্ব সতর্কীকরণ ও ঝুঁকি হ্রাসই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রধান কৌশল হওয়া উচিত। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের নীতি-পরিকল্পনায় জনগণের জন্য দুর্যোগ পূর্ব পূর্বাভাস ও দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাস কৌশল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে আগাম সতর্কবার্তা উপকূলীয় সম্ভাব্য উপদ্রুত এলাকার জনগণের মাঝে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি)’ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে উপকূলে আমাদের ৭৬ হাজার ১৪০ জন প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে। বন্যাপ্রবণ এলাকায় অনুরূপ স্বেচ্ছাসেবক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রতি বছরের মতো এবারও সারাদেশে ১৩ অক্টোবর খ্রিষ্টাব্দ পালিত হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস’। দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে জনগণ ও সংশ্লিষ্টদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যই এ উদ্যোগ। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল Fighting inequality for a resilient future ভাবানুবাদ করা হয়েছে ‘অসমতার বিরুদ্ধে লড়াই করি, দুর্যোগ সহনশীল ভবিষ্যৎ গড়ি।’
বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী চিন্তায় ১৯৭২ সালে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র চালু হয়। বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সারাদেশে বর্তমানে সাড়ে তিনশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্র থেকে বন্যার আগাম তথ্য সংগ্রহ করা হয়। আকস্মিক বন্যা মোকাবিলা ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে রিমোট সেনসিং, জিআইএস, রাডার, স্যাটেলাইট তথ্য-চিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে বন্যা আসার ৩ থেকে ৫ দিন আগেই বন্যার পূর্বাভাস ও বন্যার স্থায়িত্ব সম্পর্কে সতর্কবার্তা দেয়া সম্ভব হয়েছে। বিডব্লিউডিবি’র এফএফডব্লিউসি থেকে ফ্লাড অ্যাপ এবং ফ্লাড অ্যালার্টের মাধ্যমে বন্যা পূর্বাভাসের সর্বশেষ তথ্য সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন উন্নত গাণিতিক মডেল ব্যবহার করে ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস ও সতর্কতাবার্তা প্রদান করা হচ্ছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ‘ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্র’ থেকে বর্তমানে গাণিতিক আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল ‘ডব্লিউআরএফ’ ব্যবহার করে ৭ থেকে ১০ দিনের পূর্বাভাস অনেক নির্ভুলভাবে পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। বজ্রপাতে প্রাণহানি কমানোর লক্ষ্যে এবং দেশবাসীকে আগাম সতর্কবার্তা দিতে দেশের ৮টি স্থানে পরীক্ষামূলকভাবে বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ যন্ত্র বা লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর বসানো হয়েছে। তাছাড়া বজ্রপাতপ্রবণ ১৫টি জেলার ১৩৫ উপজেলায় ৩৩৫টি বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া কালবৈশাখী ও টর্নেডোর পূর্বাভাস বিষয়ে বর্তমান সরকার কার্যক্রম শুরু করেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল কর্তৃক ২০১৭ সাল থেকে খরা পর্যবেক্ষণ ও পূর্বসতর্কীকরণ পদ্ধতির উন্নতি সাধন করা হয়েছে, যাতে করে বাংলাদেশের কৃষক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত যে কোনো খরা মোকাবিলায় আগাম কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আরও সময়োপযোগী ও কার্যকরী সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হবে।
দুর্যোগের আগাম সতর্কবার্তা প্রচারে দুর্যোগের প্রাক্কালে রেডিও, টেলিভিশন ও মাইকিং-এর মাধ্যমে প্রচারণার পাশাপাশি সার্বক্ষণিক দ্রুত ও অধিকতর কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে টোল ফ্রি ১০৯০ নম্বরে Interactive Voice Response (IVR) চালু করা হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ৩২টি কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুর্যোগের আগাম সতর্কবার্তা প্রচার করা হয়ে থাকে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আগাম সতর্কবার্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বন্যা, ঝড়, বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম সতর্কবার্তা প্রস্তুতি ও প্রচারে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। সম্প্রতি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তিন দিনে আকস্মিক বন্যার পূর্বাভাস প্রচলন করা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর বর্তমানে স্থানীয় পর্যায়ে বন্যার আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রচারের জন্য কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও জামালপুর জেলায় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বন্যার আগাম সতর্কবার্তা সব পর্যায়ে প্রচার করার মাধ্যমে বন্যার ঝুঁকি হ্রাসে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সার্বিক সাফল্য অর্জনে স্থানীয় পর্যায়ে শক্তিশালী কাঠামো নির্মাণের লক্ষ্যে বিভাগ থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিকে শক্তিশালীকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে দুর্যোগ বিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলি (এসওডি) এর আলোকে রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট টুল ব্যবহার করে দুর্যোগে ঝুঁকিহ্রাস, আপৎকালীন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও মহড়ার মাধ্যমে এর কার্যকরী ব্যবহার ও হালনাগাদকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের সক্ষমতা বৃদ্ধি বিবেচনায় রেখে এ সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলোর জন্য প্রযোজ্য কমিটিগুলোর আলোকে বুকলেট প্রণয়ন ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।
দুর্যোগে বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, জনপ্রতিনিধি, স্বেচ্ছাসেবক, শিক্ষক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও বিভিন্ন পর্যায়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (ঘউগজঞও) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, নারী, প্রবীণ নাগরিক ও শিশুসহ সকল স্তরের জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট আইনি কাঠামো ও নির্দেশিকায় অন্তর্ভুক্তিমূলক দুর্যোগঝুঁকি হ্রাস এবং সাড়াদান কার্যক্রমের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দুর্যোগঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় অবকাঠামোগত উন্নয়নের অংশ হিসেবে ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৪২ হাজার ৯২৯টি দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণ করা হয়েছে এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে বরাদ্দকৃত আরও ২৪ হাজার ৬১৩টি দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়/জলোচ্ছ্বাসে ঝুঁকিগ্রস্ত মানুষদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে ৩২৭টি বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। বন্যাপ্রবণ ও নদীভাঙন এলাকায় ২৩০টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে এবং ৪২৩টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলমান। উপকূলীয় ও বন্যা উপদ্রুত এলাকার ১৫৫টি উপজেলায় ৫৫০টি বহুমুখী মুজিবকিল্লা নির্মাণ এবং বিদ্যমান ১৮৯টি মুজিবকিল্লার সংস্কার ও উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। গ্রামীণ রাস্তায় ১৫ মি. দীর্ঘ সেতু/কালভার্ট নির্মাণে এ পর্যন্ত ৩৮ হাজার ৭৮৬টি সেতু/কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। গ্রামীণ রাস্তাগুলো টেকসইকরণের লক্ষ্যে ৬ হাজার ৭৮৮.৭৮ কি.মি. রাস্তা এইচবিবিকরণ করা হয়েছে এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৭৯.৫০ কি.মি. রাস্তা এইচবিবিকরণ প্রক্রিয়াধীন আছে। ৬৪ জেলায় ৬৫টি জেলা ত্রাণ গুদাম কাম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তথ্যকেন্দ্র নির্মাণের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে ৬১টি জেলা ত্রাণ গুদাম কাম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তথ্য কেন্দ্র নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং বাকি ৪টির নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে।
ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সংগ্রহের জন্য প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প চলমান। পাশাপাশি ভূমিকম্পসহ বড় ধরনের দুর্যোগ পরবর্তী অনুসন্ধান, উদ্ধার ও পুনর্বাসন কার্যক্রম সমন্বিতভাবে মোকাবিলার লক্ষ্যে ওয়ান স্টপ সেন্টার হিসেবে National Emergency Operation Center (NEOC) প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। এছাড়া বন্যা ও অন্যান্য দুর্যোগ কবলিত মানুষকে উদ্ধার করার জন্য ৬০টি বিশেষ Multipurpose Rescue Boat তৈরি ও হস্তান্তর করা হয়েছে। এ সমস্ত কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশের সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
পিআইডি নিবন্ধ