চৌকিতে কেনাবেচা চলছে

দুশ্চিন্তায় বঙ্গবাজারের পোশাক সরবরাহকারীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক: পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজারের দোকান মালিকদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন অনেকেই। আপাতত চৌকি পেতে তাদের ঈদের আগে কেনাবেচার সুযোগও তৈরি করে দেয়া হয়েছে। তবে এই বঙ্গবাজারে যাদের তৈরি পোশাক বিক্রি হতো, সেই কারখানা মালিকদের দুশ্চিন্তা কাটছে না।

তারা বলছেন, ঈদের আগে অর্ধেক বাকিতে দোকানে দোকানে পোশাক দিয়ে আসেন তারা। এবারও দিয়েছেন। বেচাকেনা শেষে ঈদের আগের রাতে দোকান মালিকেরা তাদের বাকি টাকা পরিশোধ করে দেন। কিন্তু এবার আগুন লাগার পর দোকান মালিকরা বাকি পরিশোধের ক্ষেত্রে গরজ দেখাচ্ছেন না।

দেশে পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজারের একটি বঙ্গবাজার গত ৪ এপ্রিল ভয়াবহ আগুনে সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। এতে তিন হাজার ৮৪৫টি দোকান পুড়ে ৩০৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তদন্ত কমিটি হিসাব দেখিয়েছে।

ঈদের আগে বিপুল পরিমাণ নতুন কাপড় তুলেছিলেন দোকানিরা। সেগুলো পুড়ে যাওয়ায় তাদের আর্তনাদ দেখে অনেকেই এগিয়ে এসেছেন তাদের সহায়তায়।

অর্থ সহায়তা আসার পাশাপাশি ধ্বংসস্তূপ দ্রুত পরিষ্কার করে একটি অংশে বুধবার থেকে দোকানিদের চৌকি পেতে বসার সুযোগ করে দিয়েছে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ।

তবে এই বঙ্গবাজারের পেছনের ব্যবসায়ীরা আড়ালেই থেকে গেছেন। তাদের কেউ বুধবার দোকানিদের নতুনভাবে বেচাকেনার উদ্বোধন দেখতে এসেছিলেন। সেই সঙ্গে বাকি অর্থ পরিশোধের তাগাদা দেয়াও ছিল তাদের উদ্দেশ্য।

তাদের একজন ‘স্বর্ণা গার্মেন্টস’-এর মালিক লুৎফর রহমান জানালেন, এই ঈদে বঙ্গবাজারের আটটি দোকানে ১০ লাখ টাকার পোশাক দিয়েছেন তিনি। আগুন লাগার পর থেকে দোকানিরা বলছেন, তাদের সব মাল পুড়ে শেষ হয়ে গেছে।

দোকানদাররাও এখন আমাদের পাত্তা দিচ্ছে না, আবার সরকারের পক্ষ থেকেও সহায়তার কোনো আশ্বাস নেই, বলেন তিনি।

লুৎফরের কারখানার একটা অংশ ছিল বঙ্গবাজারের তিনতলাতেই, আর বাকি অংশ তিনি সুরিটোলায় সরিয়ে নিয়ে গেছেন। তার কারখানায় মূলত মেয়েদের কামিজ তৈরি হয়।

দীর্ঘদিন ধরে এভাবে বাকিতে বঙ্গবাজারে মালামাল দিয়ে আসছিলেন বলে জানিয়ে লুৎফর বলেন, দেশীয় বাজারের তৈরি পোশাকের ব্যবসার ৮০ শতাংশই এমন বাকিতে চলে। যেমন ঈদের আগে ১০ লাখ টাকার কাপড় সরবরাহ করে তিনি অগ্রিম পেয়েছিলেন দুই লাখ টাকা।

“হয়তো কোথাও ১০ লাখ টাকার পণ্য দিছি, ২৬-২৭ রোজায় ডাইকা হ্যারা আট লাখ টাকার ক্যাশ আর এক লাখ টাকার চেক ধরায়া কইতÑবাকি এক লাখ টাকা ‘লেস’ দিতে হইব। আমরাও খুশি মনে মাইনা নিই। হেই টাকায় ইসলামপুরের কাপড়ের দাম শোধ করি, কারখানার কাটিং মাস্টার, কারিগর সবার বেতন দিয়া আমার লাভ থাকে। এইবার একেবারে সব খালি। কর্মচারীগো বেতন ক্যামনে মিটামু, জানি না। কাপড়ের দামের টাকাটাও তো দিতে হইবে।”

মক্কা-মদিনা গার্মেন্টসের মালিক মনিরুল ইসলাম মধু ছয় মাস আগে বঙ্গবাজার থেকে নিজের কারখানা সরিয়ে নেন কামরাঙ্গীরচরে। ঈদের আগে ১০টি দোকানে পোশাক সরবরাহ করেছেন। তার অবস্থাও লুৎফরের মতোÑএখন দোকানিদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

মনিরুল বলেন, “আমাগো দিকে কেউ তাকাইতেছে না। এই মার্কেটে যেই মাল পুড়ছে, তার অর্ধেকেরও বেশি আমাগো মতো কারখানা মালিকগো সাপ্লাই করা। ৮০ পার্সেন্টই বাকির মাল। মানে আমরা দিছি, এহনও টাকা পাই নাই। এহন দোকানদারগো দোকান পুড়ছে বইলা হ্যারা সাহায্য টোকাইতাছে। তারা আমাগো মালের ট্যাকাও দিতে চায় না, আবার সরকারও আমাগো দেখতাছে না। আমরা মানববন্ধন করলাম, কিন্তু কেউ জিগাইলোও না আমরা কারা, কী চাই।”

মনিরুল ও লুৎফরদের মতো অভ্যন্তরীণ বাজারে তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের একটি সংগঠন রয়েছে, নাম অভ্যন্তরীণ পোশাক প্রস্তুতকারক সমিতি।

তবে কতসংখ্যক ব্যবসায়ী বঙ্গবাজারে পোশাক সরবরাহ করে থাকেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি এই সমিতির নর্থ-সাউথ রোড শাখার সভাপতি আশরাফউদ্দীন।

তিনি বলেন, “আমাদের কিছু সদস্য আছে যারা বঙ্গবাজারে মাল দিত। কিন্তু এখন কে কে সেখানে ব্যবসা করত, তার পুরো তথ্য আমাদের নলেজে তো নেই। আমরা বলছি, যারা বঙ্গবাজারভিত্তিক ব্যবসা করে, তারা যেন সমিতিকে জানায়।

“কোন দোকানে তারা কত টাকা পায়, সেই প্রমাণ থাকতে হবে। বঙ্গ মার্কেট পুড়ছে, তাদের কারখানা তো আর পোড়েনি, কারখানা মালিকের কাছে রিসিট বা ডকুমেন্ট থাকার কথা। এই প্রমাণসহ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমরা তাদের দাবি-দাওয়া উত্থাপন করব। সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ তো আর কেউ পাবে না। যতখানি পারা যায়, আমরা চেষ্টা করব।”

কারখানা মালিকদের পাওনার বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাগো দোকানদারেরা একটা কাপড় বাঁচাইতে পারে নাই। আমরা চেষ্টা করতাছি দোকানদারগো বাঁচাইতে। আর হেই পাইকারেরা আইছে টাকা চাইতে। আপনাগো কাছে গেলে আপনারা তাগো কইবেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাইতে।’

বঙ্গবাজারের সামনের রাস্তাটি আগুন লাগার পর থেকেই বন্ধ ছিল। ৯ দিন পর বুধবার চৌকি বসিয়ে কেনাবেচা শুরুর সঙ্গে সেটিও খুলে দেয়া হয়েছে। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বঙ্গবাজারের উল্টোদিকের বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেট, বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্স ও পাশের এনেক্সকো টাওয়ারের দোকানগুলোও খুলেছে।

দুপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্থায়ী ভিত্তিতে চৌকি পেতে ব্যবসা কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস।

প্রথম দিনে প্রায় ৭০০ জনকে দোকান বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। চৈত্রের খরতাপের মধ্যে ছাতা মাথায় চৌকির ওপর কেনা-বেচা শুরু করেছেন দোকানিরা।

বঙ্গবাজার দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম জানান, প্রতিটি দোকানের জন্য একটি করে পাঁচূতিন ফুটের চৌকি বসাতে দেয়া হচ্ছে। প্রথম দিনে ৬৮৮ জনকে ব্যবসার জায়গা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।

ডিএসসিসির মালিকানাধীন এক একর ৭৯ শতক জায়গার ওপর গড়ে ওঠা টিন-কাঠের বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় আগুনে। গত দুদিনে টিন-গ্রিলসহ কয়েক হাজার টন লোহা সরিয়ে জায়গাটা অস্থায়ীভাবে ব্যবসার জন্য উপযুক্ত করার কাজ করছেন ডিএসসিসির কর্মীরা। আগুনে পুড়ে যাওয়া চারতলা মহানগর কমপ্লেক্স ভাঙার কাজ বুধবার পর্যন্ত শেষ হয়নি।

ডিএসসিসি মেয়র তাপস বলছেন, ভবনটি ভেঙে সরিয়ে নেয়ার কাজ অচিরেই শেষ হয়ে যাবে এবং পুরো জায়গাজুড়ে ব্যবসায়ীরা বসতে পারবেন। তাদের মাথার ওপর ছাউনি ও বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থাও করা হবে।