দুশ্চিন্তায় যশোরের রাজারহাটের চামড়া ব্যবসায়ীরা

মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর: কোরবানির ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে, যশোরের রাজারহাটের চামড়া বাজারের চামড়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে ততই বাড়ছে দুশ্চিন্তা। অস্থিরতায় পার হচ্ছে তাদের দিন। ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে বিগত বছরের বকেয়া ১০ কোটি টাকা আদায় না হলে এ বছর চামড়া কিনতে হিমশিম খেতে হবে বলে দাবি তাদের। দুই বছর ধরে বকেয়া পড়ে থাকা পাওনা টাকা পরিশোধ করেননি ট্যানারি মালিকরা, যে কারণে পুঁজি হারিয়ে তারা এখন নিঃস্বপ্রায়।

যশোরের রাজারহাট দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম বৃহত্তম চামড়ার হাট। সপ্তাহের দুই দিন এ হাটে চামড়া বেচাকেনা হয়। এ হাটে যশোরসহ খুলনা বিভাগের ১০ জেলার ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, ঝালকাঠি, রাজশাহী, পাবনা, ঈশ্বরদী ও নাটোরের বড় ব্যবসায়ীরা চামড়া বেচাকেনা করেন। সাধারণত কোরবানির পর এ হাটে লক্ষাধিক চামড়া ওঠে এবং ঈদ-পরবর্তী প্রথম ও দ্বিতীয় হাটে অন্তত ১০ কোটি টাকারও বেশি টাকার চামড়া বেচাকেনা হয়। কিন্তু একদিকে চামড়ার দরপতনসহ ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে বকেয়া আদায় না হওয়ায় তাদের কপালে পড়েছে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। সেইসঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে লবণ ও শ্রমিকের মূল্য বৃদ্ধি। তাই এ বছর চামড়া কেনাবেচা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছেন তারা।

এদিকে চলতি বছর লবণজাত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৭ থেকে ৫২ টাকা, গত বছর যা ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। একই চামড়া ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট ৪০ থেকে ৪৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা গত বছর ছিল ৩৩ থেকে ৩৭ টাকা। এছাড়া সারাদেশে খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা, গত বছর যা ছিল ১৫ থেকে ১৭ টাকা। পাশাপাশি প্রতি বর্গফুট বকরির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ থেকে ১৪ টাকা, যা গত বছর একই ছিল। মঙ্গলবার এ দাম ঘোষণা করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।

রাজারহাট মোকামের কয়েকজন খুচরা ব্যবসায়ী বলেন, কয়েক বছর আগেও একটি কোরবানির গরুর চামড়া প্রায় তিন হাজার টাকা পর্যন্ত দামে কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কিনে নিতেন, আর সেই টাকা যেত কোরবানির বিধান অনুযায়ী গরিব মানুষের পকেটে। এখন সেই চামড়ার ক্রেতাও নেই অনেক ক্ষেত্রে। একদিকে করোনা, অন্যদিকে ব্যাপক দরপতনের কারণে গত তিন বছরের বিপুল লোকসানের তিক্ত অভিজ্ঞতায় গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চামড়ার কোনো ক্রেতা নেই।

রাজারহাটের চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, রাজারহাটের চামড়া বাজারের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে ১০ কোটি টাকা বকেয়া পড়ে রয়েছে। তিন বছর ধরে তারা পাওনা টাকা পরিশোধ করেননি, যে কারণে তারা পুঁজি হারিয়ে এখন নিঃস্বপ্রায়। কিন্তু তারা আমাদের টাকাপয়সা দিচ্ছেন না।

ব্যবসায়ীরা জানান, একদিকে ট্যানারি মালিকদের কাছে অনাদায়ী বকেয়া, অন্যদিকে রয়েছে অব্যাহত লোকসানের চাপ, যে কারণে মূলধন সংকটে আছেন তারা। সরকারের কোনো ঋণ সুবিধাও মিলছে না। ফলে কোরবানি ঈদ-পরবর্তী হাটে চামড়া কেনার জন্য নগদ টাকার বিকল্প সন্ধানে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা চেষ্টায় আছেন যার যার মতো করে টাকা জোগাড়ের জন্য।

ব্যবসায়ীরা আরও জানান, লবণের মূল্য ও শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ার কারণেও নতুন করে আরও বেড়েছে দুশ্চিন্তা। নিজেদের অর্থ ব্যয় করে চামড়ার ব্যবসা করেও লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানান তারা।

যশোরের রাজারহাট চামড়া বাজারের সাবেক ইজারাদার হাসানুজ্জামান জানান, চামড়ার দাম এখন মোটামুটি ভালো। তারপরও চামড়ার যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, সে অনুযায়ী বেচাকেনা হবে। ব্যবসায়ীরাও সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের উপকরণের দাম অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার চীনে লকডাউন এবং রপ্তানিতে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এ কারণে ট্যানারি মালিকরা কী পরিমাণ চামড়া কিনবেন এবং কীভাবে কিনবেন, সেসব নিয়েও তারা ভাবছেন।

বৃহত্তর যশোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন মুকুল বলেন, ১০ হাজার চামড়া ব্যবসায়ীর সমন্বয়ে রাজারহাট চামড়ার হাটে কোরবানি ঈদ-পরবর্তী হাটে লক্ষাধিক চমড়া বেচাকেনার মধ্যে দিয়ে অন্তত শতকোটি টাকা হাতবদল হয়। চলতি বছর চামড়া বেচাকেনার জন্য নগদ টাকা সংগ্রহসহ অন্যান্য প্রস্তুতি শুরু করেছেন তারা। এ হাটের অনেক ব্যবসায়ীর মূলধন ট্যানারি মালিকদের কাছে আটকে আছে। গত কয়েক বছরের লোকসান ও বকেয়া আদায় না হওয়ায় কোরবানি-পরবর্তী চামড়ার ব্যবসা নিয়ে তারা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। আমি আশা করছি, ট্যানারি মালিক ও আড়তদাররা ঈদের আগে আমাদের সমুদয় টাকা পরিশোধ করবেন।