এম এ কাদের: কাগজ আবিষ্কারের পর সময়ের প্রয়োজনে একাদশ শতাব্দীতে চীনে প্রথম সংবাদপত্রের প্রচলন হয়। ভারত উপমহাদেশের প্রথম সংবাদপত্র বেঙ্গল গেজেট নামে ১৭৮০ সালে ইংরেজি ভাষায় ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার তৎকালীন রাজধানী কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। ১৮২২ সালে সাপ্তাহিক সমাচার চন্দ্রিকা, ১৮২৯ সালে সাপ্তাহিক বঙ্গদূত, ১৮৩৯ সালে সাপ্তাহিক সংবাদ প্রভাকর, ১৯২৩ সালে কল্লোল ও ১৯৪১ সালে সবুজপত্র প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে বর্তমানে নিবন্ধিত মোট সংবাদপত্রের সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ২০০টি এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার (টেলিভিশন চ্যানেল) সংখ্যা প্রায় ৪০টি। এছাড়া বর্তমানে হাজার হাজার অনলাইন পত্রিকার মাধ্যমে প্রতিদিন সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হাজার হাজার সাংবাদিক, কলামিস্ট নামমাত্র পারিশ্রমিকে এমনকি বিনা পারিশ্রমিকে প্রতিদিন নিরলসভাবে সংবাদ প্রকাশে সহায়তা করে আসছে। দেশের অগ্রযাত্রায় সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের ভূমিকা নিয়ে মার্কিন সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন বলেছেন, প্রতিদিন ২টি করে সূর্য ওঠে, একটি প্রভাত সূর্য এবং অন্যটি সংবাদপত্র সূর্য। সূর্যের আলোয় সমস্ত জগত উদ্ভাসিত হয়। তেমনিভাবে গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের কল্যাণে পুরো বিশ্বেও স্বরূপ উম্মোচিত হয়। সংবাদপত্রের কলমসৈনিকদের ক্ষুরধার লেখনী, কলাম, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও প্রতিবেদন মানুষকে নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন করে তোলে। এরপরও সাংবাদিকদের নির্যাতন, নিপীড়ন এমনকি হত্যা পর্যন্ত করা হচ্ছে। গত ২০১২ সালে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা ও চলতি বছরে সংবাদকর্মী রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অপমানসূচক আচরণ সারাদেশের সচেতন মানুষকে হতবাক করেছে।
সরকার ও জনগণের মধ্যে গণমাধ্যমকর্মীরা সেতুর কাজ করে থাকে। সাংবাদিকরা হলেন জাতির বিবেক। তাই দেশকে এগিয়ে নিতে কলামিস্ট ও সাংবাদিকদের দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন সাংবাদিক ও কলামিস্ট নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে রাত-দিন জীবনের সোনালি সময় ব্যয় করে গণমানুষের সমস্যা ও সম্ভাবনার খোঁজে কান পেতে থাকেন। দিনের শেষে তার পাঠানো সংবাদ পরদিন পত্রিকার পাতায় পাঠক হাতে পেলে বাস্তবের প্রতিফলন ঘটে। এটাই সংবাদকর্মীর সফলতা। গণমাধ্যম ছাড়া কোনোভাবেই জনগণ কী ভাবছে, সরকার কী করছে তা প্রকাশ পাওয়া সম্ভব নয়। আজ মিডিয়া বা গণমাধ্যমের কল্যাণে পুরো পৃথিবী একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা একে অন্যের জীবনযাত্রা, সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে জানতে পারছি। মূলত গণমাধ্যম জাতীয় উন্নয়ন, গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সুশাসনের জন্য শক্তিশালী ও সহায়ক অনুষঙ্গ। কলামিস্ট সমাজে আসলেই কী হচ্ছে, তা গবেষণার মাধ্যমে তুলে ধরেন। সুস্থ সমাজে স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং প্রগতিশীল গণমাধ্যম থাকা দরকার, যার মাধ্যমে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীনদের কঠিন প্রশ্নের সাহায্যে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়।
একজন আত্মসচেতন সংবাদকর্মী দেশ ও জাতির জন্য পথপ্রদর্শক। মূলত সংবাদকর্মীরা মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা, চাহিদা, প্রয়োজন ও স্বপ্নকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। আর তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব জনপ্রতিনিধি, সরকার বা রাষ্ট্রের। কোনো অবহেলিত ও অনগ্রসর জনপদের সমস্যা, সম্ভাবনা ও প্রতিকার লেখনীর মাধ্যমে চিহ্নিত করতে সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সংবাদপত্রের ভূমিকা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। আধুনিক প্রচার মাধ্যম সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়ে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। সুবিধাবঞ্চিত জনপদ ও নাগরিকদের আধুনিক ও সমৃদ্ধ মানুষে পরিণত করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমই ভূমিকা রাখে। আর এই গণমাধ্যমকে পরিচালিত করে থাকেন সংবাদকর্মীরা। উন্নয়নের জন্য যেমন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, কৃষি উন্নয়ন বা ভালো শিক্ষাব্যবস্থা দরকার, তেমনি দেশকে এগিয়ে নিতে স্বাধীন গণমাধ্যম দরকার। একমাত্র গণমাধ্যমই পারে মানুষকে নতুন নতুন চিন্তা, ধারণা ও পদ্ধতি সম্পর্কে প্রতিনিয়ত তথ্য সরবরাহ করে উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। আজকের যুগে গণমাধ্যম শিক্ষা, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, লাইফ স্টাইল, রেসিপি, চিকিৎসা, প্রযুক্তি, আইসিটি, চাষাবাদ, ক্রয়-বিক্রয় থেকে শুরু করে নাগরিক জীবনের প্রয়োজনীয় সব চাহিদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করছে। নানা সীমাবদ্ধতা আর সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি সত্ত্বেও গণমাধ্যম সমাজের উন্নয়ন নিশ্চিত করছে। সাধারণ মানুষ ও গণমাধ্যমের কার্যকর অংশগ্রহণ ছাড়া রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণার মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত যে স্বাধীন গণমাধ্যমের সঙ্গে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, উন্নত শিক্ষা ও সামাজিক সেবা, দুর্নীতি ও সংঘবদ্ধ অপরাধ হ্রাসের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। ফলে এখানেও বিনিয়োগ করতে হবে, যেমনটা অন্য সব ক্ষেত্রে করা হয়। যে দেশের গণমাধ্যম যত স্বাধীন, সে দেশে গণতন্ত্র ব্যবস্থা তত উন্নত। আর এই গণতন্ত্রের উন্নয়নের কারণেই দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়ে থাকে।
আমাদের দেশে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা অনেক নাজুক। এ কারণেই সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানি বেড়েই চলেছে। তৃণমূল থেকে সংবাদ সংগ্রহের জন্য মফস্বল সাংবাদিকদের গুরুত্ব অনেক বেশি, কিন্তু তারা নানাভাবে অবহেলিত। সামাজিক ন্যায়বিচার ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে সংবাদপত্রের ভূমিকা অপিরিসীম। নাগরিকদের মধ্যে বিজ্ঞানমুখী চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রেও সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জনস্বার্থ ও মানবতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থানই সংবাদপত্রকে জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। কাজেই জনগণ এবং সরকারকে অবশ্যই এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং সাংবাদিকদের মূল্যায়ন করতে হবে।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
makader958@gmail.com