মো. জাহাঙ্গীর আলম খান: নদীমাতৃক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নৌপরিবহন খাতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি, মৎস্য সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম বিবেচনায় নিয়ে নদী রক্ষায় সার্বিক ও সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব ও সার্বিক নির্দেশনায় নৌ-সেক্টর দ্রুত বিকশিত হচ্ছে।
দেশের ক্রমবর্ধমান আমদানি-রপ্তানির চাহিদা মেটাতে একবিংশ শতাব্দীর যুগোপযোগী, আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব সমুদ্রবন্দর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পটুয়াখালীতে দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর পায়রা বন্দর নির্মাণ করা হয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে পায়রা বন্দরে বহির্নোঙরে অপারেশনাল কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ পর্যন্ত ১০৪টি বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজের অপারেশনাল কার্যক্রম সম্পন্ন করে সরকারের ২৩৬ কোটি টাকা আয় হয়েছে। সরকারের মেগা প্রকল্প হিসেবে পায়রা বন্দরে একটি কন্টেইনার টার্মিনাল, বন্দরের মূল চ্যানেলে ক্যাপিটাল ও রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং, একটি বাল্ক টার্মিনাল, একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল, একটি প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, বিদ্যুৎ প্লান্ট, মডার্ন সিটি, বিমানবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলাসহ ১৯টি কম্পোনেন্টের কাজ চলমান রয়েছে। আগামী ২০২৩ সালে পায়রা বন্দরকে বিশ্বমানের একটি আধুনিক বন্দর হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর অতিরিক্ত চাপ কমানো এবং ব্যাপকসংখ্যক জাহাজ ও কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের লক্ষ্যে সরকার কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। ১৬ মিটার গভীরতার জাহাজ বন্দরে প্রবেশের সুবিধা পাবে। মাতারবাড়ী বন্দর সড়ক, রেল ও নদীপথ দিয়ে সংযুক্ত থাকবে। বন্দরকে কেন্দ্র করে একটি সুপরিকল্পিত কানেক্টিভিটি গড়ে উঠবে। মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়নের প্রাথমিক কাজ ২০২৬ সালে শেষ হবে।
এছাড়া নৌপথ খননে ৩৪টি ড্রেজার সংগ্রহ ও সুষ্ঠু ফেরি পারাপারের লক্ষ্যে ১৭টি ফেরি নির্মাণ করা হয়েছে। ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খননের কার্যক্রম, নদীতীর দখলমুক্ত করা এবং নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। উচ্ছেদের পর পুনর্দখলরোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে নদীর উভয় তীরে ওয়াকওয়ে, পাকা সিঁড়ি, বসার বেঞ্চ, ইকোপার্ক নির্মাণ, নদীর পাড় বাঁধাই, গাইড ওয়াল নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ প্রবৃতি কার্যক্রম চলমান রয়েছে। নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনা এবং দখল ও দূষণরোধে ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন’ গঠন করা হয়েছে। পানগাঁওয়ে অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মিত হয়েছে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের গতিশীলতা আনয়নে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং চট্টগ্রাম বন্দরে বে-টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯২ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে হ্যান্ডলিং করা হয়ে থাকে। এ বন্দরকে আরও গতিশীল করতে ব্যাপক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক শিপিং জার্নাল ‘লয়েডস লিস্ট’-এর জরিপে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০টি কন্টেইনার পোর্টের তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দর ২০০৯ সালে ৯৮তম অবস্থান থেকে মাত্র ১১ বছরে ৪০ ধাপ এগিয়ে ২০২০ সালে ৫৮তম অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে খালেদা জিয়ার শাসনামলে মোংলা বন্দর লোকসান করেছিল ১১ দশমিক পাঁচ কোটি টাকা। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এটি আয় করেছে ৩৩৮ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম বন্দরে নিরাপত্তা জোরদারের লক্ষ্যে বন্দরে যাতায়াতকারী ট্রাক-ট্রেইলার স্ক্যানিং করার জন্য দু’স্তরের গেট স্থাপন এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে কন্টেইনার ও জাহাজ ট্র্যাকিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেরিটাইম সেক্টরে মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং সিলেট, রংপুর, বরিশাল ও পাবনায় চারটি নতুন মেরিন একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে ছয়টি জাহাজ সংগ্রহ করা হয়েছে। আরও ছয়টি জাহাজ সংগ্রহের কাজ চলমান রয়েছে। নাবিকদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের কারিগরি নৌ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রি-সি প্রশিক্ষণ প্রদান করে সমুদ্রগামী জাহাজে চাকরি করার উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নাবিকরা দেশি-বিদেশি সমুদ্রগামী জাহাজে চাকরি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। বিদেশি জাহাজে কর্মরত নাবিকদের জন্য মেশিন রিডেবল ‘আইডি কার্ড’ কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ নৌপথে নৌযান দুর্ঘটনা হ্রাসকল্পে নৌযানের সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি উন্নত এবং নৌযানের ডিজাইন অনুমোদন প্রক্রিয়া আধুনিকায়ন ও অনলাইনে করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চাহিদাকে সামনে রেখে বাংলাদেশের কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৬ মিটার গভীরতা এবং আট হাজার টিইইউ’স (২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে কন্টেইনার) ধারণক্ষমতাসম্পন্ন কন্টেইনার জাহাজ প্রবেশ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য কক্সবাজার জেলার মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে। বেনাপোল স্থলবন্দরসহ নতুন ১২টি স্থলবন্দরের উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘বঙ্গবন্ধু নদী পদক’ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা ঝেড়ে ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি। বিশ্ব গণমাধ্যমে একসময় শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নাম আসত এ দেশের। এখন উন্নয়নের নতুন মডেল হিসেবে আখ্যা দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশকে। মাতারবাড়ী ও পায়রা সমুদ্রবন্দর পুরো দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বাণিজ্যিক প্রকল্প। এ বন্দর বাস্তবায়ন করা গেলে বিশ্বব্যাংক প্রকল্পিত শীর্ষ বৃহৎ অর্থনীতির পাঁচ দেশে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত অনেকখানিই ত্বরান্বিত হবে। তাই মাতারবাড়ী ও পায়রা সমুদ্রবন্দর রূপান্তরকে দেখা যায় সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশের যাত্রা হিসেবে।
পিআইডি নিবন্ধ