কোনো দেশের উন্নয়নে দাতা সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নেওয়া একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে সে ঋণ যেন দেশের জন্য গলার কাঁটা হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকে লক্ষ রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। আর এ ঋণ সহায়তায় যেসব করা হয়, তা থেকে কী ধরনের অর্থনৈতিক লাভ বা রিটার্ন পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে প্রকল্প গ্রহণের আগেই বিচার-বিশ্লেষণ করা উচিত। তা না হলে ভবিষ্যতে দেশ ঋণ-জালে আটকে যাওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে। গত মঙ্গলবার বিশ্বব্যাংকের বাংলদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রকাশ অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত থেকে এমন শঙ্কার কথাই জানিয়েছেন দেশের দুই প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর ও হোসেন জিল্লুর রহমান।
তাদের শঙ্কা একেবারে অমূলক নয়। কারণ এরই মধ্যে বিভিন্ন বড় প্রকল্পে অনেক বড় ঋণ নেওয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু এগুলোর রেট অব রিটার্ন এখনও অস্পষ্ট বা অজানা। বিশেষত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে যে ঋণ নেওয়া হবে, এককভাবে তা আমাদের বর্তমান মোট জিডিপির প্রায় চার শতাংশ। এ ঋণ অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। এ ধরনের ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সবার আগে বিবেচনা করতে হবে আমাদের সক্ষমতার বিষয়টি।
বর্তমানে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের মহাসড়কে রয়েছে। এ সড়কে অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, সন্দেহ নেই। আর তা যদি হয় ঋণের অর্থে, তাহলে সেটা নেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। কারণ রেট অব রিটার্ন নির্দিষ্ট না করে যদি ঋণ নেওয়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে দেশ ঋণ-ফাঁদে পড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বিশ্বে ঋণ-ফাঁদে পড়ে যাওয়া দেশের নজিরও কম নয়। প্রতিবেশী দেশ শ্রীলংকা এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এর আগে ইউরোপের দেশ গ্রিস বড় ধাক্কা খেয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ ঋণের জালে জড়িয়ে। ওইসব দেশকে এখন বাজেট প্রণয়ন করতে হয় অনেক বছর আগে উন্নয়নের জন্য নেওয়া ঋণের সুদ ও মূল ঋণ পরিশোধের রূপরেখা মাথায় রেখে। ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় শ্রীলংকাকে রাষ্ট্রীয় নানা বিষয়ে নীতিগত ছাড়ও দিতে হচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশও ঋণ-জালে আবদ্ধ হয়ে যাক, এমনটি কারও কাম্য নয়।
ওই দুই অর্থনীতিবিদের মতে, একসময় বাংলাদেশ ঋণের ক্ষেত্রে রেড জোনে ছিল। তখন জিডিপির অনুপাতে এর পরিমাণ ছিল ৮০ শতাংশের ওপরে। একসময় তা কমতে কমতে ১২ শতাংশে নেমে আসে। ঋণের ক্ষেত্রে তা ছিল আমাদের জন্য গ্রিন জোন। বর্তমানে এ ঋণ জিডিপির প্রায় ৩২ শতাংশ। জিডিপির অনুপাতে ঋণ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে আমাদের ঋণনির্ভর প্রকল্পগুলোর গুণগত বাস্তবায়ন নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ঋণের অর্থে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তার প্রায় কোনোটির কাজই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না। দুই থেকে তিনবার প্রকল্প সংশোধনের নজিরও রয়েছে। এমন পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হওয়ায় তা থেকে মানুষের যে সুফল পাওয়ার কথা ছিল, সেটা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা। অন্যদিকে বাড়ছে ঋণের দায়। এতেই শঙ্কিত দুই অর্থনীতিবিদ। ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে দেশ যেন কোনোভাবেই আগেকার রেড জোনে চলে না যায়, সে বিষয়ে এখনই সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এগুলোর পাশাপাশি বিরামহীনভাবে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। আমদানির আকার বড় হওয়ায় কমছে এর বিপরীতে ব্যয় মেটানোর জন্য আমাদের রিজার্ভের সক্ষমতা। বর্তমানে এটি গ্রিন জোন থেকে ইয়েলো জোনে প্রবেশ করেছে। এ পরিস্থিতি যেন আরও খারাপ না হয়, সেজন্যও পর্যবেক্ষণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। অর্থনীতিবিদদের এসব শঙ্কা সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেবে, এমনটিই প্রত্যাশা।

Print Date & Time : 26 July 2025 Saturday 12:03 am
দেশ যেন ঋণ-ফাঁদে না পড়ে
সম্পাদকীয় ♦ প্রকাশ: