Print Date & Time : 21 July 2025 Monday 9:52 pm

দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে বাড়তি ব্যয় ৪,১৪০ কোটি টাকা

ইসমাইল আলী: কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প নেয়া হয় ২০১০ সালে। যদিও পরে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা প্রণয়নেই যায় আট বছর। এতে এক হাজার ৮৫২ কোটি টাকার নির্মাণব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। তবে মিয়ানমারের অনুমতি না মেলায় বাদ যাচ্ছে প্রকল্পটির রামু থেকে সীমান্তবর্তী ঘুনধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের অংশ।

এদিকে প্রায় ১৪ বছর ধরে চলা দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ শেষ হলেও ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড এখনও বাকি আছে। এতে আরও এক বছর বাড়ানো হবে প্রকল্পটির মেয়াদ। তবে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় ধরা হয়। চার হাজার ১৪০ কোটি টাকা বাড়তি অর্থ ব্যয় না হওয়ায় প্রকল্পটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি প্রকল্পটির পিইসি (প্রজেক্ট ইভালুয়েশন কমিটি) সভায় ব্যয় কমানোর প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহে তা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায়। সেখানেই প্রকল্পটির বাড়তি ব্যয় কাটছাঁট চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করা হবে।

সূত্রমতে, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার ১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৫ হাজার ৪৭৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। তবে এ রেলপথ নির্মাণে প্রকৃত ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার ৩৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এতে ব্যয় কমছে চার হাজার ১৪০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা বা ২৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এছাড়া রামু থেকে ঘুনধুম ২৮ কিলোমিটার অংশ বাদ যাওয়ায় ওই অংশের ব্যয়ও কমছে দুই হাজার ৫৫৮ কোটি ১২ লাখ টাকা। অর্থাৎ দোহাজারী থেকে কক্সবাজার হয়ে ঘুনধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে ব্যয় কমছে ছয় হাজার ৬৯৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা।

প্রকল্পটির ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ ও পরামর্শক খাতে বাড়তি ব্যয় ধরা হয়েছিল তিন হাজার ৪৩০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে রেলপথ নির্মাণেই বাড়তি ব্যয় ধরা হয় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। বাকি অর্থ পরামর্শক ও এনজিও সেবা, ভ্যাট-শুল্ক, বেতন-ভাতা এবং কন্টিনজেন্সি (দর সমন্বয়) বাবদ বাড়তি ধরা হয়।

এদিকে জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন খাতে বাড়তি ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭১০ কোটি তিন লাখ টাকা। এ খাতের মধ্যে জমি অধিগ্রহণে বাড়তি ব্যয় ধরা হয় ৬৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর জমিতে বিদ্যমান স্থাপনা বা বাড়িঘর কেনায় বাড়তি ব্যয় ধরা হয় ১০৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এছাড়া অধিগ্রহণকৃত জমিতে থাকা গাছের মূল্য অতিরিক্ত ধরা হয়েছিল ৪২ কোটি ২৬ লাখ টাকা এবং শস্য ও মাছের ক্ষতিপূরণ বাবদ আরও বাড়তি ধরা হয়েছিল তিন কোটি ছয় লাখ টাকা। আর এসব সম্পদ অধিগ্রহণে সরকার-নির্ধারিত অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধে বাড়তি প্রিমিয়াম ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩১ কোটি ২২ লাখ টাকা। এসব জমি অধিগ্রহণ কাজে প্রশাসনিক ব্যয় বাবদ বাড়তি ব্যয় সাত কোটি সাত লাখ টাকা। আর এ খাতে অপ্রত্যাশিত কোনো কাজে ব্যয় হতে পারে বলে অতিরিক্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১৪১ কোটি ৯২ লাখ টাকা।

অন্যদিকে অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে বাড়তি ব্যয় ধরা হয়েছে সব মিলিয়ে ১৯৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্টাম্প ডিউটি বাবদ অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। আর এ খাতে অপ্রত্যাশিত কোনো কাজে ব্যয় হতে পারে বলে অতিরিক্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এছাড়া পুনর্বাসনে এনজিও বা পরামর্শক নিয়োগ বাবদ অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১ কেটি আট লাখ টাকা।

জানতে চাইলে প্রকল্পটি গ্রহণকালে দায়িত্বে থাকা কোনো কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের এক অতিরিক্ত মহাপরিচালক সম্প্রতি শেয়ার বিজকে বলেন, দোহাজারী-কক্সবাজার অংশের ব্যয় প্রাক্কলনের চেয়ে ২২ শতাংশ কম দর প্রস্তাব করেছিল ঠিকাদার। এ কারণে ব্যয় সাশ্রয় হয়েছে। আর মিয়ানমার আগ্রহ না দেখানোয় রামু-ঘুনধুম অংশটিও বাদ যাচ্ছে। ওই অংশের ব্যয় পুরোটাই বাদ যাচ্ছে। এজন্য প্রকল্পটি সংশোধন করতে হচ্ছে। তবে ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড শেষ না হওয়ায় এর মেয়াদ আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

রেলওয়ের তথ্যমতে, ২০১০ সালে দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি পাস হওয়ার সময় তিন বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০১৩ সালে এটি নির্মাণ শেষ করার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। এজন্য ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার পর্যন্ত মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেন শেখ হাসিনা। তবে রেলপথ নির্মাণে সমীক্ষা করতে গিয়ে নানা বিষয় সামনে আসে রেলের।

সংরক্ষিত বনাঞ্চল, হাতি চলাচলের পথ, প্রস্তাবিত রেলরুটের জনবসতিপূর্ণ কিছু অংশে মানুষের বসতবাড়ি গড়ে ওঠা, ক্যান্টনমেন্ট এলাকা প্রভৃতি কারণে অ্যালাইনমেন্টে পরিবর্তন আনতে হয়। এছাড়া মিটারগেজ থেকে রেলপথটি ডুয়েলগেজে রূপান্তরের পরিকল্পনাও নেয়া হয়। এসব বিষয় বিবেচনায় রেলপথটির বিস্তারিত সমীক্ষা ও ডিজাইনশেষে ব্যয় বাড়ে প্রায় ৮৭৪ শতাংশ।

এদিকে রেলপথটি নির্মাণ করতে গিয়ে পরিবেশ ধ্বংসের বিশাল আয়োজন করা হয়। এ কাজে রেলওয়ের পাশাপাশি বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় পেছন থেকে ভূমিকা রাখে। আর পরিবেশ বিনাশের জন্য পুরো চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিবেশের ওপর পড়েছে বিরূপ প্রভাব। এ ক্ষতি কখনোই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া হাতি চলাচলের রুট হওয়ায় এ পথে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মিত রেলপথের মধ্যে দোহাজারী থেকে চকরিয়া হয়ে হারবাং পর্যন্ত প্রায় ৬৭ কিলোমিটার পাহাড়ি এলাকার সংরক্ষিত বনভূমি কাটা হয়েছে। ব্যাপকভাবে কর্তনকৃত বৃক্ষরাজির অবস্থান দোহাজারী জঙ্গল চুনতি, নাপিতখালী ঝিওলঞ্জা ও হারবাং ফুলছড়ি। এসব এলাকায় ১০২ প্রজাতির পাঁচ লক্ষাধিক গাছ কাটা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ৫০ প্রজাতির প্রায় তিন লাখ সাধারণ গাছ, ছয় প্রজাতির প্রায় ৬৫০টি ঔষধি গাছ এবং ৩৫ প্রজাতির প্রায় দুই লাখ ফলদ ও বনজ গাছ।

নির্মিত রেলপথটি নদী, পাহাড়, পাহাড়ি জলীয় ধারা এবং সমুদ্রের খাঁড়ি অতিক্রম করেছে ১৭৭টি স্থানে। এর মধ্যে ৯১টি স্থানে পাহাড় কাটা হয়েছে প্রায় ১৩ কিলোমিটার। এছাড়া বিলুপ্তপ্রায় হাতি চলাচলের পথ ধ্বংস হয়েছে ১১টি স্থানে। বিশ্বে সংরক্ষিত বন, বনজ সম্পদ, পাহাড় আর বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস করে রেলপথ নির্মাণের এরূপ ভয়াবহ নজির বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

অন্যদিকে চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় চুনতিতে ঢাকা-কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেনের ধাক্কায় ১৩ অক্টোবর গুরুতর আহত হয় একটি বুনো হাতি। এতে হাতিটির পেছনের ডান পা ভেঙে যায়, মাথায় এবং মেরুদণ্ডে গুরুতর আঘাত পায়। তবে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুদিন পর ১৫ অক্টোবর হাতিটি মারা যায়।