দ্রুত নগরায়ণ ও নৈতিকতার অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে ঢাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক : গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী র. আ. ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেছেন, দ্রুত নগরায়ণ, নির্মাণ নিয়ন্ত্রণের অভাব ও নৈতিকতার অভাবজনিত কারণে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলা শহর অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাবে শহরের উš§ুক্ত এলাকা বেদখল হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, নির্মাণের মান নিয়ন্ত্রণ, বিল্ডিং কোড এবং অন্য স্ট্যান্ডার্ডগুলো মেনে চলার জন্য যে প্রক্রিয়া আবশ্যক, বর্তমান বাস্তবতায় তা অপর্যাপ্ত বলে মনে করা হয়।

রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল শনিবার রাজউক আয়োজিত ‘ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার অন আরবান আর্থকোয়েক রেজিলিয়েন্স’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী সেমিনারের প্রথম দিনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী ও আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের পরিচালক ড. আবদুল লতিফ হেলালী।

সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব নবীরুল ইসলাম, রাজউকের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সিদ্দিকুর রহমান সরকার, আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের আন্তর্জাতিক দলনেতা ড. এসকে ঘোষ, জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কিমিরিও মেগুরো, বুয়েটের অধ্যাপক মেহেদী আহমদ আনসারী এবং রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. সুলতান আহমেদ প্রমুখ।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে সেমিনারে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী র. আ. ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেন, ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ছে। বিদ্যমান দুর্বলতাকে কাটিয়ে সরকার দুর্যোগ ঝুঁকি এড়াতে কাজ করে যাচ্ছে। ভবনের তদারকির সঙ্গে সঙ্গে নিয়ম চাপিয়ে না দিয়ে জনগণকে ভূমিকম্প/ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

তিনি বলেন, দ্রুত নগরায়ণ, নির্মাণ নিয়ন্ত্রণের অভাব ও নৈতিকতার অভাবজনিত কারণে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলা শহর অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাবে শহরের উš§ুক্ত এলাকা বেদখল হয়ে যাচ্ছে। নির্মাণের মান নিয়ন্ত্রণ, বিল্ডিং কোড ও অন্য স্ট্যান্ডার্ডগুলো মেনে চলার জন্য যে প্রক্রিয়া আবশ্যক, বর্তমান বাস্তবতায় তা অপর্যাপ্ত বলে মনে করা হয়।

ঢাকার দ্রুত বৃদ্ধি ও অভিবাসনের ফলে ভূমিকম্প এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপদের ঝুঁকি ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। ঝুঁকি-সংবেদনশীল ভূমি ব্যবহারের পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন নীতি ও কৌশলগুলো প্রয়োগের মাধ্যমে বিদ্যমান দুর্বলতাকে কাটিয়ে একটি স্থায়ী ও ঝুঁকিমুক্ত শহর গড়ে তোলা যেতে পারে।

মন্ত্রী আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বড় কোনো ভূমিকম্পের ঘটনার অনুপস্থিতির কারণে শহরে ভূমিকম্পের ঝুঁকি এবং এই ধরনের ঘটনার প্রভাব প্রশমিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কৌশলগুলোর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবনের ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে, ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের আরও সমন্বিত পদ্ধতি প্রণয়ন প্রয়োজন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (২০২১-২০২৫), ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা এবং জাতীয় ভূমিকম্প কন্টিনজেন্সি প্ল্যান এরই মধ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে। এই পরিকল্পনাগুলো দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দায়িত্ব ও কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করেছে। তথাপি প্রণীত পরিকল্পনাগুলোয় জাতীয় ভূমিকম্প কৌশলের ব্যাপক ও সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির অভাব রয়েছে বলে মনে করা হয়। এছাড়া শহরে ভূমিকম্পের ঝুঁকির মতো কঠিন সমস্যা মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে কার্যক্রম পরিচালনায় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাব রয়েছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিশেষ করে শহরে ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় সমন্বিত কোনো জাতীয় নীতি নেই। যদিও একটি ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ শহর নির্মাণে এ ধরনের একটি সমন্বিত জাতীয় নীতি প্রণয়ন আবশ্যক।

ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য বর্তমানে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দেশে বিদ্যমান স্কুল-কলেজসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক বিল্ডিং এবং জননিরাপত্তাজনিত বিষয়গুলোর দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে কোনো বিস্তারিত ধারণাপত্র তৈরি করা হয়নি। ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর ভূমিকম্পের ঝুঁকি প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য বিদ্যমান দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা, মূল্যমান করা ও সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সেমিনারের গেস্ট অব অনার প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, বর্তমানের দূরদর্শী পরিকল্পনাই ভবিষ্যতের ঢাকাকে গড়ে তুলবে। ১২৫ বছর ধরে বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সহসাই একটি বড় ভূমিকম্প হতে পারে। তাই এ বিষয়ে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করছে সরকার। যত দ্রুত সম্ভব এ কাজটি করতে হবে।

সেমিনারে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের পরিচালক ড. আবদুল লতিফ হেলালী বিষয়ভিত্তিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বলেন, বিগত ১০ বছরের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কারিগরি ও দক্ষ জনবল এবং সংগ্রহকৃত আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং ল্যাবরেটরি পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে ভূমিকম্প ও ?দুর্যোগ থেকে দেশের সম্পদ ও জনগণের জান-মালের সুরক্ষা দেয়ার জন্য যে বিপুল সামর্থ্য সৃষ্টি হয়েছে, তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংরক্ষণ, প্রয়োগ ও পরিচালনা করা প্রয়োজন। উল্লিখিত সামর্থ্য টেকসইভাবে প্রয়োগের জন্য একটি বিশেষায়িত কারিগরি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা আবশ্যক।

প্রস্তাবিত এই প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন এবং প্রশিক্ষিত জনবল দ্বারা পরিচালনা করতে হবে বলে সরকারের প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও পে-স্কেলে পরিচালনা করা বাস্তবসম্মত নয়। সরকারের সম্পূর্ণ মালিকানায় এবং উপযুক্ত ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে সরকারের আর্থিক সংশ্লেষ ছাড়া স্ব-উপার্জনে টেকসইভাবে পরিচালনার নজির রয়েছে, যেমন সিইজিআইএস, আইডব্লিউএম, আইআইএফসি, এসইমি ফাউন্ডেশন, ?বিআইডিএস প্রভৃতি।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ভূমিকম্পের দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের লক্ষ্যে তুরস্কে ইস্তাম্বুল প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেশন ইউনিট, ইস্তাম্বুল সেসমিক অ্যান্ড ইমারজেন্সি প্রিপেয়ারনেস প্রোগ্রাম (আইপিসিইউ-আইএসএমইপি), নেপালে ন্যাশনাল সোসাইটি ফর আর্থকোয়েক টেকনোলজি (এনএসইটি) ইন্দোনেশিয়ায়, ইন্দোনেশিয়া সেন্টার ফর হাউজিং অ্যান্ড সেটেলমেন্ট (পিইউএসকেআইএম, যুক্তরাষ্ট্রে পেসিফিক আর্থ ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্স সেন্টার, জাপানে বিল্ডিং রিসার্স ইনস্টিটিউট (বিআরআই) এবং ইরানে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভূমিকম্প দুর্যোগ ঝুঁকির ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপকহারে কমানোর প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের কোনো সংস্থায় ভবনগুলোর ঝুঁকি নিরূপণ করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন প্রক্রিয়ার কোনো অনুসন্ধান ও পরীক্ষার সুযোগ-সুবিধা নেই। বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন আনুযায়ী, রাজধানী ঢাকা ছাড়াও বাংলাদেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি শহর, যেমন সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর চট্টগ্রাম, কক্সবাজার প্রভৃতি ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। সুতরাং ওই নগরগুলোয় ভূমিকম্প দুর্যোগ সক্ষমতার জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরি। প্রস্তাবিত বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের সুফল পাওয়ার জন্য এর কার্যক্রম শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ না রেখে সমগ্র দেশব্যাপী বিশেষ করে উল্লেখিত বড় বড় শহরে পরিচালনা করাই যুক্তিযুক্ত।

প্রকল্প পরিচালক বলেন, বর্তমান প্রচলিত নির্মাণকাজের অনুমতি প্রদানপত্র (সিপি) পদ্ধতিটি যুগোপযোগী এবং প্রকৌশলগত পদ্ধতিতে না হওয়ায় কাঠামো নকশা পরীক্ষা ও ভবন নির্মাণ তদারকি করা সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

ভূমিকম্প প্রকৌশল, নির্মাণকাজের অনুমতিপত্র (সিপি) প্রদান পদ্ধতির সংস্করণ ও বাস্তবায়ন, বিএনবিসি পরিচালন এবং অনুসন্ধান ও পরীক্ষণের কাজের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ও জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের অভাব রয়েছে। প্রস্তাবিত বিশেষায়িত সংস্থাটি ঢাকাসহ সারাদেশে যুগোপযোগী এবং প্রকৌশলগত পদ্ধতিতে নির্মাণকাজের অনুমতি প্রদান ও বাস্তবায়ন এবং বাস্তবায়ন ও বিএনবিসি পরিপালন, অনুসন্ধান ও পরীক্ষাকরণ কাজে সহায়তা করবে।

প্রস্তাবিত বিশেষায়িত সংস্থাটি উল্লিখিত আধুনিক যন্ত্রপাতি, সফটওয়্যার, সিসমিক ল্যাবরেটরি, দক্ষ মানবসম্পদ প্রভৃতি দ্বারা সারা দেশে ভূমিকম্প দুর্যোগ ঝুঁকি হ্র্র্রাস কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। ফলে সারা দেশে ভূমিকম্প দুর্যোগ ঝুঁকি হ্র্র্রাস কার্যক্রম পরিচালনায় সরকারের অতিরিক্ত আর্থিক সংশ্লেষ প্রয়োজন হবে না।

এই সেমিনারে বক্তারা বিল্ডিং কোড এনফোর্সমেন্ট ও আপডেটিংয়ের বিষয়ে আলোকপাত করেন। কারণ একটি আপডেটেড বিল্ডিং কোড ছাড়া টেকসই ও ভূমিকম্প প্রতিরোধী ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা স্মার্ট সিটি ডেভেলপমেন্ট সম্ভব নয়। এ বিষয়ে এস কে ঘোষ তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশ বিল্ডিং কোড ২০২০ সালের নামে গেজেট হলেও তা আসলে ১৪ বছরের পুরোনো। ফলে হাই-স্ট্রেংথ গ্রেড রিবার (যেমন ৮০ বা ১০০ গ্রেড রিবার) থেকে শুরু করে অনেক উন্নত নির্মাণ পণ্য ব্যবহার থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। এসব পণ্য টেকসই উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাই বিল্ডিং কোড আপডেটিংয়ের বিষয়টি প্রতি পাঁচ-ছয় বছর পরপর যেন প্রফেশনালদের মাধ্যমে করা হয়, সে বিষয়ে জোর দেন।