ধ্বংসাত্মক নয়, প্রযুক্তির ব্যবহার সৃজনশীল কাজে

জাহিদুল ইসলাম : বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। এই যুগে সবার হাতে হাতে প্রযুক্তিভিত্তিক ডিভাইস থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আধুনিক জীবনব্যবস্থার সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ হলো বর্তমান প্রযুক্তি। প্রযুক্তির কল্যাণেই মানুষের সঙ্গে মানুষের সব রকম নিত্যনতুন যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে, চর্চা হচ্ছে শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের। চিকিৎসা, উৎপাদন, বিপণনসহ এমন কিছু নেই যার মধ্যে প্রযুক্তির ব্যবহার যুক্ত হচ্ছে না। বর্তমান সময়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির এই যুগে সবকিছুই প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। প্রযুক্তি ছাড়া এখন মানুষ একেবারেই অচল। যুগ যুগ ধরে বিবর্তনের ফলে একবিংশ শতাব্দীতে এসে প্রকৃতিতে যে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে, তার অন্যতম কারণ হলো কম্পিউটার, মোবাইল, ফ্যাক্স, ইমেইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটারসহ নানা ধরনের ডিজিটাল ডিভাইসের আবিষ্কার।

বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল যুগ। প্রযুক্তির কল্যাণ কাজে লাগিয়ে সমগ্র বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয় এসেছে। পরিণত হয়েছে ছোট একটি গ্রাম বা ভিলেজে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে দেশে, দেশ থেকে বিদেশে। ইন্টারনেটের কল্যাণে আজ ভৌগোলিক সীমারেখা যেন মুহূর্তের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। প্রযুক্তির বদৌলতে সহজে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন সহজ হয়েছে। তাছাড়া চিকিৎসা ক্ষেত্রেও ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে এসেছে এক অভাবনীয় সাফল্য। ডিজিটাল প্রযুক্তির অভাবনীয় এই সাফল্যের পরেও কোথাও যেন তার ব্যর্থতা রয়েই গেছে। অসাধ্য সাধনকারী এ আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ঘটছে এখন অপপ্রয়োগ। প্রযুক্তির আবিষ্কার মানুষের দৈনন্দিন জীবনে গতি এনেছে। তেমনি অপরদিকে সৃষ্টি করেছে হাজারো বিড়ম্বনা। প্রতিটি জিনিসের যেমন ভালো দিক থাকে, তেমনি তার একটি খারাপ দিকও থাকে। বিজ্ঞানি আলফ্রেড বার্নাড নোবেল যখন ডিনামাইট আবিষ্কার করেছিলেন, তখন তিনি এর খারাপ দিকটি ব্যবহারের কথা চিন্তাও করেননি। তিনি ভেবেছিলেন মানবজাতির উপকারের কথা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আজ এই ডিনামাইট ব্যবহার হচ্ছে প্রতিশোধপরায়ণ কাজে ও ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবলীলায়। একইভাবে বিশ্বকে আধুনিক বিশ্বে রূপায়িত করতে যেসব ডিজিটাল ডিভাইস আবিষ্কার করা হয়েছে, তারও এখন ঘটছে অপপ্রয়োগ।

চলতি শতাব্দীকে বলা হয় বিজ্ঞানের শতাব্দী। গত শতাব্দী থেকে বর্তমান শতাব্দীতে আবিষ্কৃত হয়েছে উদ্ভাবনের ৯৯ শতাংশ সরঞ্জাম। এর আগ যেসব জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে, সেসব খুবই নগণ্য। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞানের উদ্ভাবনগুলো এতটাই উন্নত যে অতীতে এসব মানুষের কল্পনা এবং ক্ষেত্রবিশেষে কল্পনার বাইরে ছিল। আজকের প্রযুক্তির এ যুগে যে জাতি প্রযুক্তিতে যত বেশি দক্ষ সে জাতি তত উন্নত। বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, আগামীতে যুদ্ধ হলে তা হবে ‘প্রযুক্তি যুদ্ধ’। বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির এই যুদ্ধে মানুষের অংশগ্রহণের তেমন প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। যুদ্ধ করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট কিংবা যুদ্ধাস্ত্র। উন্নত প্রযুক্তি সাহায্যে একদিকে যেমন মুমূর্ষু রোগীকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির লাইফ সাপোর্টের মাধ্যমে বাঁচিয়ে তোলা হচ্ছে; অন্যদিকে যুদ্ধক্ষেত্রে যুক্ত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ড্রোন, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে হামলা চালাচ্ছে। প্রযুক্তির এই অভাবনীয় অগ্রগতি একদিকে যেমন মানুষের জীবনকে সহজ করেছে, তেমনি এর অপব্যবহারও জীবনকে হুমকির মুখে ফেলেছে। উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে মানুষের সদিচ্ছা প্রবল হলেও দিন দিন প্রযুক্তির ‘ইভিল জিনিয়াস’ বা ক্ষতিকর বুদ্ধিও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তির এ দুর্দান্ত প্রতাপ কিন্তু সবসময়ই মানুষের জন্য মঙ্গল বয়ে আনেনি। প্রযুক্তির কোনোটি যেমন আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়েছে, আবার কোনোটি আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রযুক্তির ইতিবাচক প্রভাবে সভ্যতার যেমন উন্নতি হয়েছে, আবার কোনো কোনো প্রযুক্তি বস্তুর অপব্যবহার হুমকি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

প্রযুক্তিনির্ভর যুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায়, বিগত সাড়ে পাঁচ হাজার বছরে পৃথিবীর বুকে মোট যুদ্ধ হয়েছে ১৪ হাজার ৫০০টি, প্রাণ হারিয়েছে ৪০০ কোটি মানুষ। বর্তমান শতাব্দীর যুদ্ধের অন্যতম হাতিয়ার হলো চালকবিহীন বিমান বা ড্রোন। গত শতাব্দী থেকেই সামরিক পরাশক্তিরা যুদ্ধে মনুষ্যবিহীন যুদ্ধ এবং সেনাদের আরও নিরাপদে রাখার তাগিদে নানা ধরনের নতুন প্রযুক্তির দ্বারস্থ হতে শুরু করে, যার ফলে আসে আজকের চালকবিহীন বিমান বা ড্রোন। বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির নিত্যনতুন ব্যবহারে সারা বিশ্ব যখন এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই আমরা নেমেছি এর অপব্যবহারের প্রতিযোগিতায়। প্রযুক্তির অপব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রযুক্তি আবিষ্কার করা হয় মানুষের কল্যাণে। কিন্তু মানুষের অকল্যাণেও প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র কখনোই মানুষের কল্যাণের জন্য নয়। আবার নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য এগুলোর প্রয়োজন রয়েছে। প্রযুক্তির অগ্রসরতা মানুষ কখনোই অস্বীকার করে না এবং করার উপায়ও নেই। তবে এর আবিষ্কার ও অগ্রসরতার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিকর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের আবশ্যকতা রয়েছে। এটা না হলে প্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে মানবসভ্যতায় বিপর্যয় নেমে আসবে। ইতোমধ্যে এই ধারণা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ ক্ষতিকর দিক বিবেচনায় বিশ্বে প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে বিভিন্ন আইন রয়েছে। এ আইনের সহায়তায়ও প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন আইন করা যেতে পারে। আইনের যথাযথ ব্যবহার যেমন প্রত্যাশিত, তেমনি আইনের অপপ্রয়োগও নিন্দনীয়। তবে দেশ, সম্পদ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর তথা ধ্বংসাত্মক তৎপরতাকে উৎসাহিত করে, এমন যে কোনো উদ্যোগ ও প্রয়োগকে অবশ্যই নিরুৎসাহিত করা অত্যাবশ্যক। প্রতিনিয়ত প্রযুক্তির অসীম জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান রাখা এবং এর পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মতো দক্ষ লোকবল তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।

তথ্যপ্রযুক্তির কথা বললেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে আধুনিক বিশ্বের যান্ত্রিক উপাদান আর উপকরণের কথা, যার মাধ্যমে মানবজীবনকে করা হয়েছে সহজ ও আরামদায়ক। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রতিটি জিনিস তৈরির মূলে নিহিত আছে মানবসমাজের কল্যাণ। কিন্তু আমরা মানবসমাজ তাকে এমনভাবে ব্যবহার করি, যা আমাদের জন্য অমঙ্গল বয়ে আনছে। তথ্যপ্রযুক্তির উপকরণগুলো ব্যবহার করার জন্য আমাদের উচিত এর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। আগামীর প্রজন্মকে রক্ষা করতে প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহারের দিকেই সব সচেতন নাগরিককে মন ও মেধাকে কাজে লাগাতে হবে। মানবতাকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য অস্ত্র ব্যবস্থায় নয়, বরং মানুষের কল্যাণে কৃষি-চিকিৎসা, মহাকাশ অন্বেষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ মানবজাতির সুবিধার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপকারী প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। আজকের বিশ্ব বিজ্ঞানের বিশ্ব। বিজ্ঞানের কল্যাণে সুদূর অতীত থেকে নানা কিছু আবিষ্কার হচ্ছে। বিদ্যুৎ, কম্পিউটার, মোবাইল প্রভৃতি বিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিষ্কার। এসব আবিষ্কার প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। এখন কোয়ান্টাম কম্পিউটার আবিষ্কারের পথে বিজ্ঞানীরা। প্রযুক্তির মাধ্যমে পৃথিবীকে এগিয়ে নিতে হবে। মানুষের কল্যাণে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হবে।

লেখক: নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়