নগদ লেনদেন কমলে অর্থ সংক্রান্ত অপরাধও কমবে

হামিদুর রহমান: মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। প্রযুক্তিনির্ভর এ সেবায় প্রচারও দ্রুত ঘটছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর তদারকিতে জালজালিয়াতি ও প্রতারণা কমেছে। ফলে গ্রাহকদের আস্থা বাড়ছে। প্রতি মাসেই গ্রাহক বাড়ছে, বাড়ছে লেনদেনের সংখ্যাও। বাড়ছে লেনদেন করা অর্থও। বর্তমানে শহরের চেয়ে মফস্বলেই এই সেবার প্রসার বেশি ঘটছে। শহর ও গ্রাম মিলিয়ে প্রতি মাসে এখন গড়ে লেনদেন হচ্ছে ৮০ হাজার কোটি টাকা। যেমন গত এপ্রিলে লেনদেন হয়েছে ৯৩ হাজার কোটি টাকা। এটি এখন পর্যন্ত এমএফএস খাতে সর্বোচ্চ লেনদেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৫টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিকাশ, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রকেট, ডাকঘর জাতীয় সঞ্চয় ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান নগদ, ইসলামী ব্যাংকের এম ক্যাশ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের উপায়, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মাই ক্যাশ, ট্রাস্ট ব্যাংকের টি ক্যাশ, চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সমন্বয়ে গঠিত শিওর ক্যাশ প্রভৃতি।

এদিকে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার প্রসার ঘটায় এর ওপর আরোপিত বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ পর্যায়ক্রমে শিথিল করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই মধ্যে লেনদেনের সীমা ও সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে বড় অঙ্কেরও বেশি লেনদেন করতে পারে, সে সুযোগও দেয়া হয়েছে। তবে এই সেবা ব্যবহার করে যাতে কোনো ধরনের অর্থপাচারের মতো কর্মকাণ্ড হতে না পারে, সেজন্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) তদারকি কার্যক্রমও বাড়ানো হয়েছে। তারপরও কিছু প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে প্রযুক্তি ব্যবহারে অসতর্ক প্রাহকরা বেশি প্রতারণার শিকার হচ্ছে। এজন্য অনলাইন লেনদেনে যাতে গ্রাহকরা গোপন পিন নম্বর বা পাসওয়ার্ড কাউকে না বলেন, সেজন্য এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে জোরালো প্রচারণা চালানো হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রতিটি এমএফএস প্রতিষ্ঠানে আলাদা পরিদর্শন ইউনিট গঠনের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে আলাদা ইউনিট গঠন করেছে।

ব্যাংকে না গিয়েও যে আর্থিক সেবা মিলবে, এমন আলোচনা ১১ বছর আগেও শুরু হয়নি। নব্বইয়ের দশকে যখন দেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহার শুরু হয়, এই ফোনই যে একসময় অনেক আর্থিক লেনদেনের বড় মাধ্যম হয়ে উঠবে, এমন পূর্বাভাসও তখন কেউ দেয়নি। আর এক দশক আগে যখন এমএফএস সেবা শুরু হয়, তখন এই সেবার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। তবে এক দশক পর বাস্তবতা হলো বিকাশ, রকেট, নগদের মতো সেবা এখন প্রতি মুহূর্তের আর্থিক প্রয়োজনে অপরিহার্য অংশ। হাতের মোবাইল ফোনটিই এখন নগদ টাকার চাহিদা মেটাচ্ছে।

এখন মোবাইল ব্যাংকিং শুধু টাকা পাঠানোর মাধ্যম নয়। এর ব্যবহার হচ্ছে সব ধরনের ছোট ছোট লেনদেনে। বিশেষ করে পরিষেবা বিল পরিশোধ, স্কুলের বেতন, কেনাকাটা, সরকারি ভাতা, টিকিট ক্রয়, বিমার প্রিমিয়াম পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ ও অনুদান প্রদানের অন্যতম মাধ্যম। আর মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা জমা করতে এখন আর এজেন্টদের কাছেও যেতে হচ্ছে না। ব্যাংক বা কার্ড থেকে সহজেই টাকা আনা যাচ্ছে এসব হিসাবে। আবার এসব হিসাব থেকে ব্যাংকেও টাকা জমা শুরু হয়েছে, ক্রেডিট কার্ড বা সঞ্চয়ী আমানতের কিস্তিও জমা দেয়া যাচ্ছে। এর ফলে একটি মুঠোফোনই যেন একেকজনের কাছে নিজের ব্যাংক হয়ে উঠেছে।

অথচ ২০১১ সালের আগে টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাতে অনেক আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হতো, যা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হতো না। বেআইনিভাবে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমেও টাকা পাঠানো হতো। এছাড়া ডাকঘরের মানি অর্ডারের মাধ্যমেও টাকা পাঠানো হতো। মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ও বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাপভিত্তিক সেবা চালুর ফলে টাকা পাঠানোর আগের সব উপকরণ এখন বলতে গেলে অচল। তবে বড় অঙ্কের টাকা পাঠাতে এখনো ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহƒত হয়। মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে হিসাব খোলা ও পরিচালনা, টাকা জমা, টাকা তোলা, টাকা স্থানান্তরের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এছাড়া বিভিন্ন কেনাকাটার বিল পরিশোধ, বিভিন্ন সেবার অর্থ পরিশোধ, রেমিট্যান্সের অর্থ গ্রহণ ও পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এর বাইরে সরকারের বিভিন্ন ভাতা এখন মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে। দেশে ২০১৪ সালে এ সেবার প্রসার ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রসারিত হয়েছে গ্রামে। শুরু থেকেই গ্রামে ব্যাংকিং সেবার প্রসার ঘটাতে এই সেবা চালু করা হয়। ২০১৫ সালের জুনে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট ছিল পাঁচ লাখ ৪৮ হাজার। গত এপ্রিলে তা বেড়ে হয়েছে ১২ লাখে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে লেনদেন হয়েছিল দেড় লাখ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে লেনদেন হয়েছে প্রায় সাত লাখ কোটি টাকা। ছয় বছরের ব্যবধানে লেনদেন বেড়েছে সাড়ে চারগুণের বেশি। একই সময়ের ব্যবধানে গ্রাহকসংখ্যা পৌনে তিন কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ১১ কোটির বেশি। ওই সময়ে গ্রাহক বেড়েছে প্রায় চারগুণ। ছয় বছর আগে লেনদেনের সংখ্যা মাসে ছিল পৌনে আট কোটি। গত এপ্রিলে তা বেড়ে হয়েছে ৩৮ কোটি।

আগে প্রতি মাসে গড়ে লেনদেন হতো ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা। গত ২০১৮ সালে তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। ওই সময়ে প্রতি মাসে গড়ে লেনদেন হয়েছে ৩০ থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা। কভিডকালে এ লেনদেন আরও বেড়ে যায়। ২০২০ সালে গড়ে ৪০ হাজার থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা প্রতি মাসে লেনদেন হয়। উন্নত দেশগুলোয় নগদ টাকার ব্যবহার অনেক কমে গেছে। অনলাইন, অ্যাপ বা ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেনকে (যাকে বলা হয় ‘প্লাস্টিক মানি’ ব্যবহার) উৎসাহিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে টাকার চলাচল দ্রুত হচ্ছে, যা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। টাকা যত দ্রুত ও বেশি হাতবদল হবে, ততই অর্থনীতি গতিশীল হবে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও নগদ টাকার ব্যবহার কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে।

আগে ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করতে ব্যাংকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। এখন মোবাইলে ফোনে আর্থিক সেবার অ্যাপ ব্যবহার করেই ওই বিল পরিশোধ করা যায় মুহূর্তেই। এই সেবা ব্যবহার করে ২০১৮ সালে বিভিন্ন সেবার বিল বা ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করতে ১৯ লাখ ৭১ হাজার লেনদেনের মাধ্যমে ২৯২ কোটি ৭০ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। গত এপ্রিলে তা বেড়ে লেনদেনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক কোটি ৩৪ লাখ। লেনদেন করা অর্থ এক হাজার ৩৩০ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

মোবাইল ফোন বা বিভিন্ন সেবার কার্ড রিচার্জ করতে আগে নির্ধারিত এজেন্টের কাছে বা ব্যাংকে যেতে হতো। এখন মোবাইল ফোনের অ্যাপ ব্যবহার করেই এগুলো করা যায়। ২০১৮ সালে গ্রাহকরা এই সেবা ব্যবহার করে মোবাইল ফোন ও বিভিন্ন সেবার কার্ড রিচার্জ করতে আট কোটি ৯৪টি লেনদেনের মাধ্যমে ৩৭৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যবহার করেছেন। গত এপ্রিলে তা বেড়ে লেনদেন দাঁড়িয়েছে ১৩ কোটি ৪৪ লাখে এবং এতে জড়িত অর্থ ৬৯৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এখন গার্মেন্টসহ বিভিন্ন ছোট প্রতিষ্ঠানকর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে।

এখন গ্রাহক ঘরে বসে এমএফএস হিসাব খুলতে পারেন। রয়েছে ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা স্থানান্তরের সুবিধাও। তাই মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব এখন সবার হাতের মুঠোয়। গ্রাহকেরা ঘরে বসেই ডিজিটাল কেওয়াইসি (আপনার গ্রাহককে জানুন) ফরম পূরণ করে সহজেই এমএফএস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে হিসাব খুলতে পারছেন। ফলে যেসব ‘ঝামেলা’ ছিল, তাও মিটে গেছে।

আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অর্থনীতিতে নগদ লেনদেন যত কমবে, অপরাধলব্ধ অর্থের ব্যবহার তত কমবে। ফলে অবৈধ অর্থ উপার্জনের প্রবণতাও কমবে। আর ডিজিটাল লেনদেন হলে সহজেই ধরা পড়বে অবৈধ লেনদেন।

ইন্টারনেট অবলম্বনে