নগরাঞ্চলে নিরাপদ খাবার নিশ্চিতে ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা নীতিমালা জরুরি

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকা শহরে ভ্রাম্যমাণ খাবার বিক্রি একটি অত্যন্ত পরিচিত দৃশ্য। স্থায়ী বা অস্থায়ী ভ্রাম্যমাণ খাবার বিক্রেতা শহরের বিভিন্ন পরিসরে তাদের পণ্য সাজিয়ে বসেন। এই হকাররা নগরবাসীর খাদ্য চাহিদা পূরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। বিশেষত নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো অনেকাংশেই ভ্রাম্যমাণ খাবার বিক্রেতার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এসব হকারদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চলার ক্ষেত্রে দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায়। বেশিরভাগ হকারদের কোনো লাইসেন্স না থাকায় তাদের কোনো পরিসংখ্যান নেই ফলে তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা ও তদারকি করা কঠিন। এ জন্য প্রয়োজন একটি হকার ব্যবস্থাপনা নীতিমালা।

গতকাল স্ট্রিট ফুড ভেন্ডিং বিষয়ে একটি ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান।

বক্তারা জানান, ভ্রাম্যমাণ খাবার বিক্রয় একটি বিশাল জনসংখ্যার আয়ের উৎস। কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী ৯৭ হাজার থেকে দুই লাখ ভ্রাম্যমাণ খাবার বিক্রেতা শাকসবজি ফলসহ বিভিন্ন ধরনের তৈরি খাবার বিক্রি করে।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ‘ঢাকা ফুড সিস্টেম’ প্রকল্পের আওতায় তিন মাস মেয়াদি একটি পাইলট প্রকল্প নিয়েছে। এর আওতায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ১০০ জন ফুড ভেন্ডরের একটি ডেটাবেস তৈরি করা হবে এবং তাদের স্বাস্থ্যবিধি-খাদ্যের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে গৃহীত একটি উদ্যোগ এবং ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট (ডব্লিউবিবি ট্রাস্ট) কার্যক্রমটি বাস্তবায়নে সহযোগী সংস্থা হিসেবে কাজ করছে।

আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের প্রকল্প কর্মকর্তা নাঈমা আকতার। তিনি বলেন, আমাদের একটি হকার ব্যবস্থাপনা নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ খাবার বিক্রেতাদের লাইসেন্সিং, ডেটাবেস তৈরি, তদারকি, হকারদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিরূপণ প্রভৃতি সম্ভব হবে। ভ্রামমাণ খাবার বিক্রেতাদের লাইসেন্স দেয়া, নবায়ন প্রভৃতির মাধ্যমে সিটি করপোরেশনের একটি আয়ের বড় উৎস তৈরি করা সম্ভব। পাশাপাশি সিটি করপোরেশন ছাড়া যেসব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রয়েছে যেমন পুলিশ, শ্রম মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়Ñ তাদের মধ্যেও সমন্বয় নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ঢাকা ফুড সিস্টেম চিফ টেকনিক্যাল অফিসার জন টেইলর। ঢাকা শহরে ভ্রাম্যমাণ খাদ্য বিক্রেতাদের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, নগরবাসী বিশেষত যারা দরিদ্র তারা অনেকেই ভ্রাম্যমাণ খাদ্য বিক্রেতাদের ওপর তাদের খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য নির্ভরশীল। ভ্রাম্যমাণ খাদ্য বিক্রেতাদের স্বাস্থ্যবিধিবিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে নগরবাসীর জন্য নিরাপদ খাদ্য জোগান নিশ্চিত করা সম্ভব।

সভার প্রধান অতিথি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, আমাদের শুধু আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না বরং ভ্রাম্যমাণ খাদ্য বিক্রেতাদের একটি ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসার জন্য মাঠপর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। সিটি করপোরেশন যেহেতু এক্ষেত্রে একটি মুখ্য অংশীদার, কাজেই আমাদের ভূমিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ইতোমধ্যে তাদের কীভাবে লাইসেন্সিংয়ের আওতায় আনা যায় সে বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মাকসুদ হাশেম বলেন, ভ্রাম্যমাণ খাদ্য বিক্রয় খাদ্য চাহিদা, কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রেও একটি ভূমিকা আছে। তারা শহরের গণপরিসরগুলো ব্যবহার করছেন। নগরব্যাপী একটি গণপরিসর ব্যবস্থাপনার একটি পরিকল্পনা নেয়া হলে তাদের ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা সহজ হবে।

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য অধ্যাপক ড. আবদুল আলীম বলেন, এই পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে একটি ডেটাবেস পাওয়া যাবে। তাদের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সিটি করপোরেশন থেকে যদি ভ্রাম্যমাণ খাদ্য বিক্রেতাদের নিবন্ধনের মাধ্যমে একটি কার্ডের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়, তাহলে সিটি করপোরেশনের আয়ের উৎস হবে। পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ খাদ্য বিক্রেতারাও চাঁদাবাজির শিকার হবেন না।

আলোচনা সভার সভাপতি ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের পরিচালক গাউস পিয়ারী বলেন, প্রতি বছর আমাদের শহরে ভ্রাম্যমাণ খাদ্য বিক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের শহরে কত সংখ্যক ভেন্ডরের স্থান সংকুলান সম্ভব, তার একটি পরিকল্পনা প্রয়োজন। পাশাপাশি তাদের একটি ডেটাবেস তৈরি আবশ্যক, যাতে তাদের সহজেই প্রশিক্ষণ ও তদারকির আওতায় আনা সম্ভব হয়। ভ্রাম্যমাণ খাদ্য বিক্রেতারা আমাদের নগরবাসীর খাদ্য চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখছেন। পাশাপাশি এটি একটি বিশাল জনসংখ্যার আয়ের উৎস। ফলে উচ্ছেদ নয় তাদের ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন।

ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের সিনিয়র প্রকল্প কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন ইউএনডিপির লাইভলিহুডস ইমপ্রুভমেন্ট অব আরবান পুওর কমিউনিটিসের (ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন) সোশিও-ইকোনমিক অ্যান্ড নিউট্রিশন এক্সপার্ট জোহরা খানম, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক আদিল মোহাম্মদ খান, এলাইভ অ্যান্ড থ্রাইভের সিনিয়র অ্যাডভাইজর ড. জেবা মাহমুদ, মমতা পল্লী উন্নয়ন সংস্থার (এমপিইউএস) নির্বাহী পরিচালক মো. ইয়াকুব আলী, সিয়ামের নির্বাহী পরিচালক মো. মাসুম বিল্লাহ প্রমুখ।