নিজস্ব প্রতিবেদক :করোনা অতিমারির সময় দারিদ্র্যের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। পরে সেটি ধীরে ধীরে কমে আসে। তবে করোনার কারণে শহরের সমাজে নতুন দারিদ্র্যের আবির্ভাব ঘটেছে। গত বছর মোট দরিদ্রের ৫১ শতাংশই ছিল নতুন দরিদ্র। তবে ঢাকা শহরে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২২ সালে সাধারণ দারিদ্র্যের হার কমেছে ৪.৩ শতাংশ। একই সময় ঢাকায় অতিদারিদ্র্যের হার কমেছে ৩.২ শতাংশ। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় অনেক পণ্য নি¤œআয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এ যুদ্ধের ফলে জ্বালানি তেল, সার ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণায় এমনটি উঠে এসেছে। রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল ‘বিআইডিএস রিসার্চ অ্যালমানাক ২০২৩ অন ডেভেলপমেন্ট প্রসপেক্টস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস’ শীর্ষক দুদিনব্যাপী সম্মেলনের প্রথম দিনে উপস্থাপিত বিভিন্ন গবেষণাপত্রে এ তথ্য জানানো হয়।
সংস্থাটির মহাপচিালক ড. বিনায়ক সেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা সচিব সত্যজিত কর্মকার। প্রথম দিনে প্রায় ১০টি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়।
বিআইডিএসের গবেষণায় বলা হয়েছে, লকডাউনের সময়টা বাদ দিলে করোনার সময়ই শুধু ঢাকা শহরে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২২-এ দারিদ্র্য কমেছে ৪ দশমিক ৩ শতাংশীয় পয়েন্ট। একই সময়ে অতি দারিদ্র্য কমেছে ৩ দশমিক ২ শতাংশীয় পয়েন্ট। এই দারিদ্র্য কমার অন্যতম কারণ হচ্ছে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি, মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম অংশগ্রহণ ও ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি, সঞ্চয় ভেঙে খাওয়া এবং সরকারি-বেসরকারি সহায়তা। সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক নানা কর্মকাণ্ডের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় মানুষ কিছু না কিছু করেছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, আগে মানুষ এত গরিব ছিল যে তখন বৈষম্য নিয়ে চিন্তা ছিল না। এক বেলা খেয়ে অন্য বেলায় খেয়েছে কি না, সেটি বড় কথা ছিল। এখন সবাই তিন বেলা খেতে পারে। এ কারণে বৈষম্য নিয়ে কথা আসছে। সরকারের নানা উদ্যোগ দারিদ্র্য নিরসনে কাজ করেছে। এখন বৈষম্য আলোচনার অন্যতম বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আমরা সম্পদ সৃষ্টি করতে চাই। ভাত, মাছ, মাংস, ডিমের মতো সম্পদ গড়তে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। সম্পদ
যখন সৃষ্টি হয় তখন বৈষম্য দেখা দেয়। কারণ কেউ মেধার গুণে বা যোগ্যতার ভিত্তিতে বেশি সম্পদ সৃষ্টি করে। কেউ পিছিয়ে থাকে। সরকার বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার সমতা সৃষ্টিতে কাজ করছে। যাতে সবাই সমান সুযোগ পায়। সামাজিক নিরাপত্তার মতো কর্মসূচি বাড়িয়ে বৈষম্যের ব্যথা কিছুটা কমার বা সহনীয় পর্যায়ে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। তিনি বলেন, এখন এদেশে গ্রাম-শহর এক হয়ে গেছে। আলাদা করে গ্রাম ও শহরের সবকিছু হিসাব করার দরকার নেই। সব কিছু ক্ষেত্রেই একটি হিসাবই যথেষ্ট।
ড. শামসুল আলম বলেন, করোনার সময় দারিদ্র্য বেড়ে ছিল এটা ঠিক। সরকারের সঠিক পরিকল্পনা এবং উদ্যোগে নিয়ন্ত্রণ কমানো সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে করোনার সময়ে বিভিন্ন উৎপাদনমুখী শিল্প-কারখানা বন্ধ না রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ কারণে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষতির প্রভাব পড়েনি। ড. বিনায়ক সেন বলেন, করোনার সময়ে দারিদ্র্য বাড়লেও সেটা ছিল সাময়িক। পরে এটা কমতে শুরু করে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত দরিদ্র বেড়েছিল। জুনের পর সেটি কমতে শুরু করে পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিকের জায়গায় চলে যায়। এ দারিদ্র্য কমার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য এখনও আছে। এটা কমাতে হলে বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই।
‘আরবান প্রভার্টি ডায়নামিস ডিউরিং কভিড-১৯: অ্যানাটমিক অব রেজিলিয়েন্স’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন ড. বিনায়ক সেন। এতে বলা হয়েছে, প্রাক-কভিড স্তর থেকে বলা হয়েছিল, দারিদ্র্য দিগুণ হয়েছিল। সেটি সেটি ঠিক নয়। ওই সময় প্রাক-কভিড স্তরের নিচে নেমে গিয়েছিল। পরে অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। ঢাকা মেগাসিটিতে দারিদ্র্য কমেছে দ্রুত। ২০১৯ এবং ২০২২-এর মধ্যে সামগ্রিক দারিদ্র্যের সংখ্যা কমেছে। কভিড-১৯-এর চাপ থাকলেও দারিদ্র্য হ্রাসে এটি একটি উলেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়। তবে ঢাকার মতো উচ্চবর্ধনশীল মেগাসিটিতে দীর্ঘস্থায়ী দারিদ্র্য এখনও যথেষ্ট। শহুরে জনসংখ্যার প্রায় এক-দশমাংশ এই শ্রেণির অন্তর্গত। করোনার ফলে উদ্ভূত একটি নতুন সামাজিক হিসাবে কিছু মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমেছিল। এটি মোট দারিদ্র্যের প্রায় ৫১ শতাংশ ছিল নতুন দারিদ্র্য। গবেষণায় দেখা যায়, কভিড-১৯-এর কঠিন মাস গুলোতে বিবাহবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি, কন্যাদের জন্য বয়ঃসন্ধিকালের বিবাহের হার বা সমাজে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে করোনার কোনো উল্লেখযোগ্য বিরূপ প্রভাব পাওয়া যায়নি। তবে কালো মেঘ অন্যদিকে দেখা গেছে। চরম দরিদ্র পরিবারের ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ বলেছে, তাদের করোনা মহামারি চলাকালীন ছেলে বা মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ করতে হয়েছে। এটি দরিদ্রদের জন্য ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। নি¤œ মধ্যবিত্তের জন্য ১০ দশমিক ৩ শতাংশ এবং উচ্চ মধ্যবিত্তের জন্য ৮ শতাংশের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। স্পষ্টতই করোনার সময়ে শিক্ষামূলক মানবিক পুঁজির বিকাশের ক্ষেত্রে শহুরে দরিদ্রতম শ্রেণি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিআইডিএসের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, করোনার আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালে দরিদ্র মানুষের মধ্যে আত্মকর্মসংস্থানের হার ছিল ৩৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। করোনার পর অর্থাৎ গত বছর সেটি বেড়ে ৩৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে অতিদরিদ্র মানুষের মধ্যে করোনার আগে আত্মকর্মসংস্থানের হার ছিল ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। করোনার পর সেটি বেড়ে ৩৩ দশমিক ২১ শতাংশে দাঁড়ায়। এ ছাড়া ২০১৯ সালে দরিদ্র খানা বা পরিবারের মধ্যে ৩৯ দশমিক ২৯ শতাংশ এমএফএস (মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস) ব্যবহার করত। করোনার পর অর্থাৎ ২০২২ সালে সেটি বেড়ে ৭৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ হয়েছে। করোনার আগে ৩২ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবারের ব্যাংক হিসাব ছিল। পরে সেটি বেড়ে হয়েছে ৩৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এদিকে অতিদরিদ্র পরিবারের মধ্যে ২০১৯ সালে ১৫ দশমিক ১৫ শতাংশ এমএফএস ব্যবহার করত। করোনার পর সেটি বেড়ে ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ হয়েছে।
সম্মেলনে অপর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশে ৩০ লাখ মানুষকে নতুন করে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এর প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য, সার এবং অপরিশোধিত তেলের দাম। যার প্রভাব পড়েছে দেশে। এই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জাতীয় কল্যাণ ২ শতাংশ কম হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের কৃষি খাত। ভর্তুকিতে সার বিক্রি উৎপাদনকে বাড়িয়েছে। কিন্তু তার থেকে সঠিক পন্থা ছিল দারিদ্র্য কমানোর জন্য নগদ অর্থ দেয়া। ২০২২ সালের প্রথম দিকে পেট্রোলিয়ামের দাম বাড়তে থাকে। শুধু ২০২১ সালের জুলাই মাসে বাড়ানো হয়েছিল। তবে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু হওয়ার কয়েক মাস পরে ২০২২ সালে জুলাইয়ে এ হার আর ও বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন সারের দামও ব্যাপক বেড়ে যায়। কিন্তু দেশে দাম কম ছিল ভর্তুকির ফলে। ফলে সরকারের ওপর অতিরিক্ত বোঝা সৃষ্টি করে। ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে খাবারের দাম ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে। চাল, গম, ভুট্টা এবং ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক মূল্য বৃদ্ধির ফলে ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত আমদানি ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু ২০২২ সালের মে থেকে এ পণ্যগুলোর দাম কমলেও দেশীয় বাজারে দামের ঊর্ধ্বগতি প্রবণতা রয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে বিনিময় হারের অবমূল্যায়ন হয়েছে।
অন্য একটি গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও তা এখনও কাক্সিক্ষত নয়। নারীরা গৃহস্থালির কাজে বেশি যুক্ত থাকায় তাদের অন্য ক্ষেত্রে দক্ষতা তৈরি হচ্ছে না। ফলে তারা পিছিয়ে যাচ্ছে।