আরফাতুর রহমান শাওন: প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের ক্লাসের পাঠ ক্লাসেই চর্চা করে সম্পন্ন করা হবে। কমিয়ে আনা হবে শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজ। এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন হবে প্রাথমিকের নতুন শিক্ষাক্রম চালু হলে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) চূড়ান্ত করেছে ‘পরিমার্জিত জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষাক্রম ২০২১’। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের ক্লাসের পড়া ক্লাসেই চর্চা করা হলে, তাদের বাড়ির কাজের চাপ থাকবে না। সন্তানদের নিয়ে অভিভাবকদেরও ছুটতে হবে না কোচিংয়ে।
নির্দিষ্ট দিনের পাঠ যেন শ্রেণিকক্ষেই শেষ হয়, সে ধরনের শিখন কার্যক্রম পরিচালনায় সচেষ্ট হয়ে বাড়ির কাজ বা হোমওয়ার্ক কমানোর অনুশাসন দেয়া হয়েছে। তাছাড়া শিশুদের খেলাধুলা ও সৃজনশীল কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা ও স্বীকৃতি প্রদানের উদ্দেশ্যে প্রতি স্তর শেষে শিক্ষার্থীকে সনদ দেয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
এক গবেষণা জরিপে বলা হয়েছে, ক্লাসে শিক্ষকদের অমনোযোগিতার কারণে ছেলেমেয়েদের নিয়ে অভিভাবকরা কোচিংয়ে ছোটেন। আবার কোথাও কোথাও শ্রেণির শিক্ষকরাই কোচিংয়ে যেতে উৎসাহিত করেন। তারা ক্লাসে না পড়িয়ে কোচিংয়ে পড়ান। অভিভাবকদের মনে শঙ্কা থাকে শ্রেণিশিক্ষকের কোচিংয়ে না পড়লে তার সন্তান পরীক্ষায় ভালো ফল করবে না। এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে এখন রেহাই পাবেন শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, পরিমার্জিত কারিকুলামে শুধু পাঠদান পদ্ধতিতে পরিবর্তনই আসবে না, সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতার ধারণাও বদলে যাবে। এই কারিকুলামের মূল লক্ষ্য হচ্ছেÑজ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গি।
প্রথম শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হবে না। চতুর্থ শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান বিষয়ে ক্লাসে মূল্যায়ন হবে ৬০ নম্বর, বাকি ৪০ নম্বরের পরীক্ষা নেয়া হবে। তবে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্পকলা বিষয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে ১০০ নম্বরের।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষাক্রম ছিল অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা। মূল্যায়ন পদ্ধতি ও কৌশল ছিল না। পরিমার্জিত কারিকুলামে যোগ্যতা, শিখনফল এবং পরিকল্পিত কাজগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক করে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। এখানে মূল্যায়ন পদ্ধতি ও কৌশল এবং ধারাবাহিক মূল্যায়নের নির্দেশনা সংযোজন করা হয়েছে।
নতুন কারিকুলামে পড়ার চেয়ে কাজ বেশি। এখানে তেমন বোঝানোর কিছু নেই। কাজের মাধ্যমে সে শিখবে। সে কাজের ওপর তার অভিজ্ঞতা তৈরি হবে। আমরা সেসব নিয়ে কাজ করছি। সারাদিন সে কী করেছে সেটি ডায়রিতে লিখতে বলা হতে পারে। পড়ার সময় জানবে তার কী কী করা উচিত আর সে কী করেছে। প্রতিদিন তার কী কী খাওয়া উচিত আর সে কী খেয়েছে সেটি সে নিজেই বুঝতে পারবে। প্রতিদিন তারা নিজের কাজ নিজে করবে। সেগুলো এখন পাঠ্য হয়ে গেছে। যেগুলো বাসায় রেখেও করা সম্ভব হবে। কিছু কিছু কাজ আছে শিক্ষকরা যদি ফোনেও বলেন তাহলেও সেটি করা সম্ভব। শিক্ষামন্ত্রী যেভাবে বলছেন আমরা যদি কিছু কাজও তাদের দিয়ে করাতে পারি তবে সেটি এগিয়ে যাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা এরই মধ্যে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। ক্লাসের জন্য প্রতিটি বিষয়ে শিক্ষক নির্দেশিকা দেয়া হবে। সেখানে কী কী করতে হবে, দেয়া হবে সে সংক্রান্ত ধারণা। প্রতি সপ্তাহে এক দিন কারিকুলাম প্রণয়ন কমিটির সঙ্গে শিক্ষকরা আলোচনায় বসে কোনো সমস্যা থাকলে সেসব নিয়ে আলোচনা করে করা হবে সমাধান।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নতুন কারিকুলামে এসএসসির আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষা থাকছে না। প্রচলিত পদ্ধতিতে পঞ্চম শ্রেণির পিইসি-ইবতেদায়ি, জেএসসি-জেডিসি এই পরীক্ষা নেয়ার সুযোগ নেই। ২০২৪ সাল থেকে প্রচলিত জেএসসি পরীক্ষা ও ২০২৫ সাল থেকে প্রচলিত পিইসি পরীক্ষাও থাকছে না।
বিভিন্ন শিক্ষাবিদের মতে, এই পরীক্ষার বাহুল্য যত কমানো যায়, তত ভালো। এখন পরীক্ষা কমিয়ে দেয়া হয়েছে, সেটা আমাদের কাছে সঠিক মনে হচ্ছে। কেননা পাবলিক পরীক্ষার নাম দিয়ে শিশুদের পরীক্ষামনস্ক করে তোলা, গাইডবই-কোচিংয়ের দিকে ঝোঁকা, এটা অন্যায্য কাজ। তারা আরও বলেন, এই ছোট ছোট বাচ্চারা ছোটবেলা থেকেই ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ডÑএসব অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বড় হয়। এখন এটা থাকবে না, কিন্তু একটা মূল্যায়ন ঠিকই হয়ে যাবে। তবে নবম-দশম শ্রেণিতে বিভাজন না থাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ কমবে বলে মনে করেন।
অষ্টম থেকে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পরই শিক্ষার্থীদের একটি বিভাগ পছন্দ করতে হতো। অর্থাৎ বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের যেকোনো একটিতে যেতে হতো। নতুন প্রণীত জাতীয় শিক্ষাক্রমে এ বিভাজন থাকছে না। নবম ও দশম শ্রেণিতে সব শিক্ষার্থীকে অভিন্ন ১০টি বিষয় পড়তে হবে।
দশম শ্রেণির আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষাও নেয়া হবে না। দশম শ্রেণির পর এসএসসির নামে পাবলিক পরীক্ষা হবে, তবে তা হবে শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে। এখন নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে পাবলিক পরীক্ষা হয়।
তারা বলছেন, ‘নবম ও দশমে শিক্ষার্থী সবাই একই বিষয়ে পড়াশোনা করবে। এ পর্যায়ের কোনো শিক্ষার্থী বিশেষ কোনো বিষয়ে পারদর্শী থাকলে, তাকে সে বিষয়ে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে। উচ্চমাধ্যমিক অর্থাৎ এইচএসসি থেকে শিক্ষার্থীদের আগের মতো বিভাগ বিভাজন করতে হবে।’
খসড়া শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে ১০টি অভিন্ন বিষয়ে পড়ানো হবে। এরপর একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে শাখা পরিবর্তনের সুযোগ রাখা হবে। বর্তমানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কিছু অভিন্ন বই পড়তে হয় এবং নবম শ্রেণিতে গিয়ে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা, এসব শাখায় ভাগ হয়ে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত যে ১০ বিষয়ে পড়ানো হবে সেগুলো হলোÑ বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, সামাজিক বিজ্ঞান, জীবন ও জীবিকা, ধর্ম, স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। বর্তমানে এসব শ্রেণিতে ১২ থেকে ১৪টি বই পড়ানো হয়।
২০২৩ সাল থেকে প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে শুরু হবে নতুন শিক্ষাক্রম। ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণি এবং ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে এ শিক্ষাক্রম শুরু হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে পুরো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।’
শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি বলেন, ‘২০২৫ সালে এটি (জাতীয় শিক্ষাক্রম) পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হবে। এতে শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, নবম শ্রেণি থেকে গ্রুপের বিভাজন আর থাকবে না। শিখন সময় কতটা হবে, তা নির্দিষ্ট করে দেয়া হবে। সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি ধারাবাহিক মূল্যায়নেও গুরুত্ব দেয়া হবে। দিনের একটি সময় শিক্ষার্থীরা যাতে নিজেদের মতো করে সময় কাটাতে পারে, সেজন্য দিনের একটি সময় তাদের সুযোগ করে দেয়া হবে।’
নতুন এ জাতীয় শিক্ষাক্রমের মূল লক্ষ্য পড়াশোনাকে আনন্দময় করে তোলা। একই সঙ্গে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর থেকে ঝরে পড়া কমানো। শ্রেণিকক্ষেই শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ পাঠগ্রহণ শেষ করতে পারা নিশ্চিত করা। অর্থাৎ পুরো শিক্ষাক্রম হবে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক।
এ প্রসঙ্গে দীপু মনি বলেন, ‘আনন্দময় পড়াশোনা হবে। বিষয়বস্তু ও পাঠ্যপুস্তকের বোঝা ও চাপ কমানো হবে। গভীর শিখনে গুরুত্ব দেয়া হবে। মুখস্থনির্ভরতার বিষয়টি যেন না থাকে, এর বদলে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শেখাকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীর দৈহিক ও মানসিক বিকাশে খেলাখুলা এবং অন্যান্য কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ক্লাস শেষে যেন শিক্ষার্থীরা নিজেদের মতো সময় কাটাতে পারে। পড়াশোনার বাইরে খেলাধুলা বা অন্যান্য বিষয়ের সুযোগ কমে গেছে, এটা যেন না হয়। জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
শিক্ষক
মিল্লাত উচ্চ বিদ্যালয়
বংশাল, ঢাকা