নতুন বছরে ব্যাংক খাতের চ্যালেঞ্জ

আকাশ শাগুন: ২০২৪ সালের সূচনালগ্নে দেশের ব্যাংক খাত বেশ কিছু গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। যদিও ব্যাংক খাতের এসব সমস্যা বেশ পুরোনো। ২০২৩-এর শেষে এসে সেই সমস্যাগুলো মহিরুহ রূপ ধারণ করেছে। সুশাসনের অভাবের পাশাপাশি ব্যাংকের যারা পরিচালক এবং যারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (এমডি ও ডিএমডি) রয়েছেন তাদের অধিকাংশের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। এ ছাড়া বিধিবিধান, নীতিমালা, আইন-কানুন যেসবের মাধ্যমে ব্যাংক পরিচালিত হওয়ার কথা সেসব পরিপূর্ণরূপে মেনে চলছেন না কেউই। এছাড়া ব্যাংকের অনেক পরিচালক নামে-বেনামে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে। আরও রয়েছে এক বিশেষ শ্রেণির ফটকা ব্যবসায়ী, যারা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আর পরিশোধ করছে না। আবার তাদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকরী ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হচ্ছে না। এতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ২০০৯ সালের মাত্র সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে তা ১.৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনার কাজে ও ঋণ মঞ্জুরির ক্ষেত্রে পরিচালকদের সরাসরি হস্তক্ষেপ ব্যাংক খাতকে নাজুক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে ব্যাংকের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যাপ্ত দেখভালের অভাব

দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।

দেশের ব্যাংক খাতে প্রধান সমস্যা তারল্য সংকট। তারল্য সংকট হলো এমন একটি অবস্থা যখন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকার সংকট হয়। আরও সহজ করে বললে, ব্যাংকগুলো যখন গ্রাহকদের চাহিদানুযায়ী টাকা সরবরাহ করতে ও বিভিন্ন আর্থিক বিল পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়, তাকে তারল্য সংকট বলে। তারল্য সংকট থেকে ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তারল্য সংকট তীব্র হলে অর্থনৈতিক সংকট আরও গভীর হয়। বিদায়ী বছরে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ তাদের সঞ্চয় ভেঙে দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাচ্ছে। ফলত তারল্য সংকটের প্রভাব পড়ছে দেশের সামগ্রিক আর্থিক খাতে। তারল্য সংকট থেকে উত্তরণ তাই হতে যাচ্ছে নতুন বছরের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ।

বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের আরেক প্রধান সমস্যা হচ্ছে খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণের সমস্যা বেশ পুরোনো হলেও একটা সময় পর্যন্ত তা সহনীয় পর্যায়ের ছিল। ব্যবসায়ীরা ঋণ গ্রহণ করে তা পরিশোধের কথা চিন্তা করতেন। এভাবে টাকার হাতবদল হতো এবং তা অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। কিন্তু ২০২৪-এর সূচনালগ্নে এটা দৃশ্যমান যে, ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশই ঋণ পরিশোধে আগ্রহী নয়। খেলাপি ঋণের এই অনাকাক্সিক্ষত উল্লম্ফন কেবল ব্যাংক খাতকেই ঝুঁকিতে ফেলছে না, সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। নতুন বছরে তাই খেলাপি ঋণ আদায় ব্যাংক খাতের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।

৩. প্রভিশন কম দেখানো: কেবল খেলাপি ঋণের পরিমাণই বাড়ছে না। শ্রেণীকরণের ক্ষেত্রেও রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি। ব্যাংক শাখাগুলো তাদের আর্থিক স্বাস্থ্য ভালো দেখানোর জন্য অনেক ক্ষেত্রেই তথ্য গোপন করে শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ কম দেখায়। প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ যা দেখানো হয় তার চেয়ে অনেক বেশি বলে ধারণা অর্থনীতিবিদদের। ডেইলি স্টার বাংলার ১ অক্টোবর ২০২৩-এর তথ্য মতে, ‘২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মোট খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ।’ কিন্তু আইএমএফ খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ শতাংসের নিচে নামিয়ে আনতে বলেছে। বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে কতটা ভালো ঋণ এবং কতটা মন্দ ঋণ সে হিসাবের ক্ষেত্রে প্রায়ই কমিয়ে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। আর্থিক বিশ্লেষণে ভালো ঋণ বলতে কোনো ঋণ বিতরণ করার পর সেটি নির্দিষ্ট সময়ে সুদে-আসলে ফেরত পাওয়া গেলে তাকে ভালো ঋণ বলে। আর কোনো ঋণ সুদে-আসলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেরত পাওয়া না গেলে তাকে মন্দ ঋণ বলা হয়।

কোনো ব্যাংকে নন-পারফর্মিং লোন বা মন্দ ঋণ বেশি থাকলে বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে, ক্ষতিগ্রস্ত ঋণ বেশি হলে বলা হয়ে থাকে যে, সেই ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্যের মান ভালো নয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিককালে কোনো ব্যাংকের দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ কত পরিমাণ তার চিত্র প্রকাশ করে না।

দুর্নীতির অভিযোগ, সুশাসনের অভাব, নিয়ম পালনে অনীহা ইত্যাদি ব্যাংকগুলোর পুরোনো সমস্যাগুলোর অন্তর্ভুক্ত। তবে বিদায়ী বছরে এ চিত্র খুব একটা সুখকর ছিল না।  অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির চিত্র সামনে আনার পরও নানামুখী চাপে কঠোর ব্যবস্থা না নেয়ায় ব্যাংক খাতে এর প্রভাব পড়েছে বেশ নেতিবাচকভাবেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নিয়ম বহির্ভূতভাবে একটি প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ব্যাংকগুলো থেকে বেশ বড় অঙ্কের টাকা ঋণ নেয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক সেখানে একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেছে। নিয়মিত বোর্ড মিটিংয়ে অংশ নেয়া ও তদানুযায়ী রিপোর্ট করা ছাড়া পর্যবেক্ষকের তেমন কিছু করার নেই। অভিযোগ গুরুতর হলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত এই পদক্ষেপ বেশ দুর্বল। অথচ এক্ষেত্রে আরও কঠোর পদক্ষেপের আশা করেছিলেন অর্থনীতিবিদরা।

আমাদের অর্থনীতিতে ডলার আসার চেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরিমাণটা বেশি। ফলে দেশের আর্থিক হিসাবেও ঘাটতি দেখা দেয়, কমে যায় দেশের রিজার্ভ। হুন্ডিতে টাকা পাঠানো সহজ ও রেট বেশি দেয়ায় রেমিটাররা ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডিতে টাকা পাঠাচ্ছে বেশি পরিমাণে। ৫ শতাংশ প্রণোদনা দিয়েও রেমিটারদের ব্যাংকমুখী করা যাচ্ছে না। ডলারের ব্যাংক রেট আর হুন্ডির রেটের পার্থক্য এত বেশি যে, অতিরিক্ত ৫ শতাংশ তা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ কারণে রেমিটাররা দেশে টাকা পাঠালেও তা আমাদের রিজার্ভে কোনো ইতিবাচক প্রভাব রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে বিদায়ী বছরজুড়ে রিজার্ভের স্থিতি পড়তির দিকে ছিল। পাশাপাশি রয়েছে বেগমপাড়া আর অর্থ পাচারের দৌরাত্ম্য। ওভার ইনভয়েসিং বা বাড়তি মূল্য দেখানোর মাধ্যমে দেশ থেকে প্রতি বছর একটা বিশাল পরিমাণ টাকা (৮ থেকে ২৭ বিলিয়ন ডলার) পাচার হয়ে যাচ্ছে। যেখানে আইএমএফ থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ৪.৫ বিলিয়ন ডলার। গত ১০ বছরে সুইচ ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা পড়া অর্থের দিকে তাকালের অর্থ পাচারের বিষয়টি

স্পষ্ট হয়।

করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্ব অর্থনৈতিক সংস্কারে অনেকটা এগিয়ে গেলেও নানা অভ্যন্তরীণ সমস্যায় দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আটকে আছে। প্রবৃদ্ধিকে ধনাত্মক মানে ফেরাতে এ খাতে সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও তা পরিপালনে জোরদার ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। সুশাসন নিশ্চিত ও খেলাপি ঋণ কমানোর পাশাপাশি প্রবাসীদের উপার্জিত আয় বৈধ পথে আনতে পারলে এ সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

ব্যাংকার