নতুন ভ্যাট আইন ভোক্তার ওপর চাপ বাড়াবে

 

সোনিয়া খান লিমা: ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হচ্ছে নতুন ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর মূসক) আইনের বাস্তবায়ন। সরকার ১ জুলাই থেকে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ কার্যকর করতে বদ্ধপরিকর। বর্তমানে ১৯৯১ সালের আইনে ‘একাধিক হ্রাসকৃত হারে’ ভ্যাট আদায় করা হয়। নতুন আইনে সব একই হারে অর্থাৎ ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় হবে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে।

নতুন আইন বাস্তবায়নে চাপে পড়বে নি¤œ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। আগামী ১ জুলাই থেকে সরকার মৌলিক ভোগ্যপণ্য ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বসাতে যাচ্ছে। ফলে নি¤œ ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় বাড়তি আর্থিক চাপ সৃষ্টি হবে। ১৫ শতাংশ ভ্যাট ব্যবসায়ী বা যিনি পণ্য বিক্রি করবেন, তার জন্য ততটা প্রভাব বিস্তার না করলেও কয়েক হাত ঘুরে যখন পণ্যটি ভোক্তার হাতে পৌঁছে, তখন সেই করের বোঝা তাকেই পরিশোধ করতে হবে। যত কষ্ট বা দুর্ভোগ সেটা আমজনতার, বিশেষ করে নি¤œ ও মধ্যবিত্তের ওপর এসে পড়বে। ধরা যাক, একটি পণ্যের আমদানি বা উৎপাদন মূল্য যদি ১০০ টাকা হয়, সেটা বাজারে আসার আগেই ১১৫ টাকা হয়ে আসবে। তারপর ডিলার বা এজেন্ট সেটা কিনবে ১৩২ টাকা দিয়ে। সেই ডিলারদের কাছ থেকে পাড়া বা মহল্লার বড় দোকানদাররা কিনে আনবেন ১৫১ বা ১৫২ টাকা দিয়ে। আর সেই পণ্যটি আমরা যখন কিনতে যাব তার ওপরে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিয়ে তখন মূল্য পড়বে ১৭৫ টাকা। তাহলে এতেই বোঝা যাচ্ছে কী পরিমাণ আর্থিক চাপে ক্রেতা, ভোক্তারা পড়বে।

ব্যবসায়ীদের ওপর আর্থিক চাপও বাড়বে। নতুন ভ্যাট আইন অনুযায়ী দেড় কোটি টাকার টার্নওভারের বেশি যাদের হবে, তাদের ঢালাওভাবে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। কিন্তু অনেক পণ্যে মূল্য সংযোজিত হয় না। তাহলে কেন সেক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট হবে? এতে পণ্যমূল্যও বাড়বে। অনেক পণ্যমূল্যে ভ্যাট সংযুক্ত রয়েছে। সেসব পণ্য বিক্রিতে নির্ধারিত মূল্যের ওপর আবারও নতুন করে ভ্যাট দিতে হবে। কারণ দোকানদারকে মোট বিক্রির ওপর মাস শেষে ভ্যাট দিতে হবে। যদিও এক্ষেত্রে রেয়াত নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু সেটা ব্যবসায়ীরা কতটা নিতে পারবেন, তা পরিষ্কার নয়। ফলে পণ্যমূল্য ও ভ্যাট সংগ্রহ দোকানদারদের জন্য বিড়ম্বনার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। উৎপাদন পর্যায় থেকে খুচরা পর্যন্ত দফায় দফায় ভ্যাট দিতে গিয়ে ক্রেতারাও আর্থিক ক্ষতিতে পড়বে। এতে স্থানীয় শিল্পের টিকে থাকাও কষ্টকর হবে। নতুন কোনো উদ্যোক্তা বিনিয়োগে সাহস পাবে না। এতে বিনিয়োগ আরও স্থবির হয়ে পড়বে।

১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করলে পণ্য ও সেবার দাম বাড়বে। ফলে অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী চাহিদা কমবে। তখন বাজারব্যবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখে শিল্পের উৎপাদনও কমে আসবে। এর প্রভাব পড়বে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের ওপর। কারণ ভোক্তার চাহিদা কমলে নতুন বিনিয়োগ আসবে না। সার্বিকভাবে নতুন ভ্যাট আইন অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। সরকার চাচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে নিয়ে যেতে। এজন্য বিনিয়োগ জিডিপির ৩৩ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। কিন্তু ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের পর পণ্যমূল্য বেড়ে যাবে। এতে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ চাপে পড়বে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে বলা হচ্ছে, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে ব্যবসা খরচ কমবে। তবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট হার রাখা হলে ব্যবসা ব্যয় কমবে বলে মনে হয় না। পাশাপাশি ভ্যাট আদায় পদ্ধতি নিয়েও ঝামেলা তৈরি হতে পারে। সর্বোপরি ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের প্রভাব মূল্যায়ন (ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) হওয়া দরকার।

নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হলে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাবে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসনির্ভর শিল্প-কারখানায় পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে স্বাভাবিকভাবেই গ্রাহকপর্যায়ে দাম বেড়ে যাবে। অর্থাৎ নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হলে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির কারণে সব ক্ষেত্রেই প্রভাব পড়বে। এখন বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিলের সঙ্গে সংকুচিত হারে ৫ শতাংশ ভ্যাট পরিশোধ করতে হচ্ছে। আগামী মাস থেকে নতুন আইন কার্যকর হলে একক হার হিসেবে সব ক্ষেত্রেই ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে। এতে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাবে। আর বিদ্যুতের দাম বেড়ে গেলে চাপে পড়বে ভোক্তারা।

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই মূসক সবচেয়ে বেশি। পাশের দেশ ভারতে মূসকের গড় হার সাড়ে ১২ শতাংশ। তবে দেশটিতে মূসকের চারটি স্তর রয়েছে। নেপালে ১৩ শতাংশ। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও মিয়ানমারে ১০ শতাংশ। এশিয়ার বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীনেও সর্বোচ্চ মূসক ১৫ শতাংশের কম। চীনে বর্তমানে চার স্তরের মূসক রয়েছে। এর মধ্যে খুচরা পণ্য, বিনোদনসামগ্রী, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ক্যাটারিং সার্ভিস, মোবাইল ফোনসেবা, ডাক বিভাগ সেবা, পরিবহন ও লজিস্টিকসের ওপর ১১ শতাংশ মূসক বিদ্যমান। আর্থিক ও বিমাসেবা, ইন্টারনেট  ডেটা, তথ্যপ্রযুক্তি ও কনসালট্যান্সি ফির ওপর ৬, জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর ৩ ও স্থানীয় শিক্ষার ওপর ২ শতাংশ মূসক রয়েছে। ভারতে রাজ্য ও পণ্যভেদে ১২ দশমিক ৫ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত মূসক আরোপ করে গত ১ এপ্রিল থেকে ‘ন্যাশনাল গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স সিস্টেমস’ চালু হয়েছে। অর্থনীতিতে বাংলাদেশের প্রায় সমকক্ষ ভিয়েতনাম শুধু বিলাসপণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ মূসক আদায় করে। অন্য বেশিরভাগ পণ্যে মূসক ১০ শতাংশ। তবে খাদ্যপণ্য, পরিবহন, মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি, কৃষিপণ্য ও সেবা খাতের ওপর ভিয়েতনামে মূসক ৫ শতাংশ। রফতানি পণ্য ও রফতানি সহযোগী পণ্য, কৃষি উপকরণ, সার ও প্রাণী-খাদ্যের ওপর কোনো মূসক বসায়নি দেশটি। এশিয়ার অগ্রসরমান অর্থনীতির দেশ সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে মূসক ৭ শতাংশ। মালয়েশিয়া ২০১৫ সালের ১ এপ্রিল থেকে ৬ শতাংশ হারে মূসক আদায় করছে।

এফবিসিসিআই’র মতে, প্যাকেজ ভ্যাট বহাল রাখা কিংবা টার্নওভার করের রেয়াতি সীমা বাড়ানো আমাদের মূল লক্ষ্য নয়। এফবিসিসিআই চায় দেশের শিল্পের বিকাশ ঘটুক। এজন্য দেশে উৎপাদিত শিল্পপণ্যের ওপরে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের যে সিদ্ধান্ত রয়েছে, তা কমানোর দাবি তাদের। এত বেশি হারে ভ্যাট বসালে দেশি পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে। ফলে ক্রেতাদের চাহিদা কমবে। এতে শিল্পের ক্ষতি হবে।

নতুন আইন বাস্তবায়ন হলে অনেক পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক উঠে যাবে। ফলে আমদানি পণ্যের দাম কমবে। এ অবস্থায় দেশি শিল্পের স্বার্থ রক্ষা ও ভোক্তার চাহিদা বাড়ানোর মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ১৫ শতাংশ ভ্যাট হার কমানোর কোনো বিকল্প নেই। অর্থনীতিবিদদের মতে, ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করা হলে পণ্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি দুই-ই বাড়বে। ভোক্তাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে এবং এতে খুচরা বিতরণব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

আমি মনে করি, ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের আগে সরকারের অর্থনৈতিক সমীক্ষা বিচার-বিশ্লেষণ করে এবং সর্বস্তরের জনগণের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করে একটি সুষ্ঠু ও কাঠামোগত ভ্যাট আইন কার্যকর করা উচিতÑযাতে সব স্তরের মানুষের কল্যাণ সাধিত হয়।

 

শিক্ষার্থী, বিবিএ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়