শিল্পী রানী শাহ: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়গুলো বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের নতুন যে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে, তা শিক্ষার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই শিক্ষাক্রমকে যুগোপযোগী ও তাৎপর্যময় করেছে, যার অন্যতম একটি হলো শিক্ষার্থীর দক্ষতা অর্জনের ওপর গুরুত্বারোপ করা। বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তর করতে এর কোনো বিকল্প নেই। এই বিশ্বায়নের যুগে শিক্ষার্থীকে পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে যে কোনো স্থানের জন্য যোগ্য ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে জ্ঞানের পাশাপাশি দক্ষতা অর্জন অবশ্যম্ভাবী। তাই নিঃসন্দেহে এটি একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত, সুবিধাবঞ্চিত, প্রান্তিক সব শিক্ষার্থীর কথা বিবেচনা করার মাধ্যমে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় Inclusive accommodation কে আরও সুদৃঢ়ভাবে নিশ্চিত করা হচ্ছে।
আমরা জানি, শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শৈশবকালীন শিক্ষা শিশুর শারীরিক, মানসিক, আবেগিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও ভাষাভিত্তিক দক্ষতাসহ সার্বিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই নতুন শিক্ষাক্রমে এ বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে দুই বছর মেয়াদে উত্তীর্ণ করা হয়েছে। এটি এই শিক্ষাক্রমের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এক্ষেত্রে এটি ‘জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০১০’-এ গৃহীত পদক্ষেপেরই বাস্তবায়ন রূপরেখা।
পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার শিক্ষার্থীর শেখার আগ্রহকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবে বলে আমি মনে করি। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা শিক্ষার্থী ও অভিভাবক উভয়ের জন্যই একটি ভীতির কারণ ছিল। একই সঙ্গে ছিল এক ধরনের প্রতিযোগিতা। তাছাড়া এটি ছিল ‘জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০১০’-এর সুপারিশবহির্ভূত উদ্যোগ। তাই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেইসি) পরীক্ষা বাতিল নতুন শিক্ষাক্রমের আরও একটি ইতিবাচক দিক, যা শিক্ষার্থীর শেখার আনন্দকে বাড়িয়ে দেবে, আর ছোট্ট শিশুও শিক্ষাকে উপলব্ধি করতে পারবে বলে আমি মনে করি।
প্রতিদিনের শিখনফল যাচাইয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নের কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র শ্রেণিকক্ষে শ্রেণিশিক্ষকের মাধ্যমেই তা সম্ভব। আর নতুন শিক্ষাক্রমে ধারাবাহিক মূল্যায়নকে প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সব পর্যায়ে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন করার পর দক্ষতার অভাবে বেকারত্বের দায় নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। নতুন শিক্ষাক্রমে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি একটি বৃত্তিমূলক বিষয় আবশ্যিকভাবে শিক্ষার্থীকে নিতে হবে, যা তাকে কর্মজগতের জন্য জ্ঞান ও দক্ষতায় পারদর্শী করে গড়ে তুলবে। তাই আমি মনে করি এটি বর্তমান শিক্ষাক্রমের আরও একটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ।
শিশুর বা কোনো শিক্ষার্থীর পরিপূর্ণ বিকাশে শিক্ষা আনন্দদায়ক হওয়া উচিত। এই শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষা যেন আনন্দদায়ক হয়, সে বিষয়ে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ফলে এই শিক্ষাক্রমে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান সম্পন্ন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। শিশুর শিক্ষা যদি প্রধানত শ্রেণিকক্ষে সমাপ্ত করা যায়, তবে শিশু বিদ্যালয়ের বাইরে বাকিটা সময় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ও তার সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা ও অন্যান্য কাজের জন্য ব্যবহার করতে পারবে। এতে করে তার বিকাশ প্রক্রিয়া আরও গতিশীল ও ব্যাপ্তিময় হবে।
শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ মূল্যবোধ শিক্ষার সংযোজন এই শিক্ষাক্রমের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য, যা শিক্ষার্থীকে আরও বেশি মানবিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে বলে আমি মনে করি।
এ শিক্ষাক্রমের কোনো নেতিবাচক দিক আছে বলে আমি মনে করি না। তবে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আর তা হলো যথাযথভাবে প্রয়োগের চ্যালেঞ্জ। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের অন্যতম দায়িত্ব শিক্ষকের। যেহেতু নতুন শিক্ষাক্রমে শ্রেণি শিক্ষা কার্যক্রম ও চলমান মূল্যায়নের ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, তাই শিক্ষককে দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও উদ্দীপনার সঙ্গে এগুলো প্রয়োগ করতে হবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষককে দক্ষ ও কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা, যেমন পর্যাপ্ত শিক্ষক, প্রশিক্ষণ, উপকরণসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষককে আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে কাজ করে যেতে হবে। একটি কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আর তা হলো শ্রেণি কার্যক্রমের দায়িত্ব শিক্ষকের হলেও তাকে সহযোগিতা করা এবং তার কাজের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা অতি আবশ্যকীয়।
সর্বোপরি নতুন প্রবর্তিত শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীর তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি তাকে একজন দক্ষ, নীতি-নৈতিকতাপূর্ণ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে, যা বাংলাদেশের নাগরিকদের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সমানভাবে এগিয়ে যেতে ও পরিবর্তনশীল সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করবে। এই শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীদের জন্য কল্যাণকর হবে বলে আমি মনে করি।
সহকারী অধ্যাপক
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়