জাতীয় নির্বাচনের ডামাডোলে রাজনৈতিক মতপার্থক্য, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিতর্ক, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনা প্রভৃতি এখন গণমাধ্যমের বড় খবর। এসবের চাপে জনদুর্ভোগের অনেক খবর তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। ঠিক এমন একটি খবর হলো ‘স্বাভাবিক জোয়ারে প্লাবিত উপকূল, বিঘ্ন ঘটছে নৌ-চলাচলে: লক্ষ্মীপুরে মেঘনায় নতুন নতুন চর, প্রভাব পড়ছে ইলিশ উৎপাদনে’ শীর্ষক প্রতিবেদন।
আমাদের প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, লক্ষ্মীপুরে মেঘনা নদীতে ভাসমান ও ডুবোচর জেগে ওঠায় লঞ্চ, ফেরিসহ নৌযান চলাচলে বিঘœ ঘটছে। ডুবোচরের কারণে নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় ইলিশ উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। নতুন চর জেগে ওঠায় নদীর স্বাভাবিক জোয়ারে পানি উপকূল এলাকাগুলোয় ঢুকে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে জনপদ, ভাঙছে নদীর তীর। স্থানীয়রা বলছেন, মেঘনার অববাহিকায় জেগে ওঠা এসব চর দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। নতুন চর জেগে নদীর তলদেশে ঢাল তৈরি হয়েছে। এতে পানিপ্রবাহে বিঘœ ঘটছে।
আমাদের প্রকৃতি, পরিবেশ, জলবায়ু, কৃষি, যোগাযোগব্যবস্থায় নদ-নদীর অবদান বলে শেষ করার নয়। মুক্তিযুদ্ধের সেøাগানেও ছিল নদীÑ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা।’ নদীতে মাছ ধরা, নৌকায় নদী পারাপার, জেলে-মাঝিদের জীবনধারা এখন বাস্তব থেকে চিত্রশিল্প হয়ে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়, পলিতে ভরাট হয়; দখলে সরু হয়। এতে পানির অভাবে নাব্য হারিয়েছে অধিকাংশ নদ-নদী। বর্ষায় সামান্য পানিও বহনের ক্ষমতা থাকে না তাই। সে সময় নদীর দু’কূল ছাপিয়ে ভাঙন শুরু হলে তড়িঘড়ি করে জানমাল রক্ষাই প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। চাপা পড়ে যায় নদী খননের বিষয়। খননের ক্ষেত্রে নদী থেকে তোলা বালুই আবার নদীতে গিয়ে পড়ছে। নাব্য বজায় রাখতে, ভাঙন ঠেকাতে এবং সুপরিকল্পিত ও দীর্ঘস্থায়ী নদীশাসনে রাজস্ব খাতের অন্তত এক শতাংশ বরাদ্দ রাখা এবং কাজের মান রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
যোগাযোগের ক্ষেত্রে একসময় নৌপথ ছিল প্রধান ভরসা। এখন সড়কপথ অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এর আওতায় অপরিকল্পিতভাবে ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের কারণেও নদীপথ পড়ছে বিপাকে। নদীর স্বাভাবিক গতিও এতে ব্যাহত হয়। এ অবস্থায় সুনির্বাচিত স্থানে ক্যাপিটাল ড্রেজিং চালিয়ে যেতে হবে। বর্ষাকালে নদীর তলানি পানির স্রোতের মধ্যে ঘেঁটে দিতে হবে, যাতে এটা জমা না হয়ে সহজে চলে যায়।
নদীভাঙন ও প্লাবন প্রাকৃতিক হলেও নদীকে স্বাভাবিকভাবে চলতে দিলে অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলো ঘটত না। নদী দখল বন্ধ করতে হবে। গৃহবর্জ্য, প্লাস্টিক বোতল, পলিথিনসহ অপচনশীল বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে হবে। নদীবন্দর সংস্কার এবং পরিকল্পিতভাবে নদীনালায় ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করা জরুরি। শিল্পবর্জ্যরে দূষণ থেকে নদী রক্ষায় শিল্পকারখানায় ২৪ ঘণ্টা ইটিপি (ইফ্লুয়েন্ট ট্রিমেন্ট প্লান্ট) চালু রাখা, হাওর-বাঁওড়-বিল ও পতিত নদীগুলোর উৎসমুখের বাধা সরিয়ে নি¤œভূমিতে জলের প্রবাহ সচল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। নদীর গতিপথ পরিবর্তনের অন্য কী কারণ থাকতে পারে সে সব অনুসন্ধানপূর্বক পদক্ষেপ নেয়া জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।