ডা. মোহাম্মদ হাসান জাফরী
(গতকালের পর)
বর্তমান বিশ্বে হেপাটাইটিস-বি একটি পরিচিত রোগ। মূলত বড়দের রোগ হলেও নবজাতক বা শিশুদের এ রোগ হতে পারে এবং জীবনে নানারকম জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। হেপাটাইটিস-বি লিভারের একটি মারাত্মক রোগ, যা হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়। এমনকি অনেক বছর পরও লিভারে মারাত্মক প্রদাহের সৃষ্টি হতে পারে। হেপাটাইটিস-বি আক্রান্ত রোগীর রক্ত ও দেহরসের মাধ্যমে ছড়ায়। জন্মের সময় নবজাতক তার মায়ের কাছ থেকে সংক্রমিত হতে পারে। মা যদি আগে হেপাটাইটিসে আক্রান্ত থাকে, সেক্ষেত্রে শিশুটি যখন তার মায়ের রক্ত বা জরায়ু থেকে নিঃসরিত রসের সংস্পর্শে আসে, তখনই সংক্রমিত হয়। বুকের দুধের মাধ্যমে এই ভাইরাস সংক্রমিত হয় না। খেলাধুলার সময় আঘাতের কারণে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত শিশুর কাছ থেকে রক্তের মাধ্যমে সুস্থ শিশুতে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে। ইনজেকশন দেয়ার সময় জীবাণুমুক্ত সরঞ্জাম ব্যবহার না করলে বা দূষিত রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে একজনের কাছ থেকে আরেকজন সংক্রমিত হতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিশুদের মধ্যে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্তের লক্ষণ প্রতিফলিত হয় না। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে শিশুর চামড়া, চোখ ও প্রস্রাব হলুদ হয়ে যায়, পেটব্যথার পাশাপাশি জ্বর হয়, ক্ষুধামান্দ্য ও বমি-বমি ভাব বা বমি হয়ে থাকে, মাংসপেশি ও হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা হয়। হেপাটাইটিস-বি ছাড়াও অন্যান্য হেপাটাইটিস ভাইরাস, বিশেষত হেপাটাইটিস-এ ভাইরাস দ্বারাও শিশু আক্রান্ত হতে পারে। হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত শিশুরাই ভবিষ্যতে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের দীর্ঘমেয়াদি বাহক হওয়ার ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং অন্যদের মাঝে ভাইরাস সংক্রমিত করে, যার ফলে লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারের কারণে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের ইপিআই কর্মসূচিতে পেন্টা ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া, যা শিশুদের দেহে মারাত্মক সংক্রমণ ঘটায়। এ রোগের জীবাণু রোগাক্রান্ত শিশুর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। সুস্থ শিশু আক্রান্ত শিশুর সংস্পর্শে এলে এমনকি আক্রান্ত শিশুর ব্যবহƒত সামগ্রী যেমন তোয়ালে, খেলনা ইত্যাদির মাধ্যমে এ জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে এবং রোগের সৃষ্টি করে। সংক্রমণের মধ্যে অন্যতম হলো ব্যাকটেরিয়াল ম্যানিনজাইটিস, যা ব্যাকটেরিয়াজনিত মস্তিষ্কের সংক্রমণ ও মারাত্মক নিউমোনিয়া। এছাড়া এ ব্যাকটেরিয়া রক্ত, অস্থিসন্ধি, হাড়, গলা, কান ও হƒৎপিণ্ডের আবরণের সংক্রমণ ঘটায়। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না করলে আক্রান্ত শিশু প্রতিবন্ধী হয়ে যেতে পারে, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সঠিক চিকিৎসার পরেও শিশু মৃত্যুবরণ করতে পারে। হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি রোগটি সাধারণত পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের হয়ে থাকলেও চার থেকে ১৮ মাসের শিশুরাই এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশী ঝূঁকিপূর্ণ। শিশুর জšে§র পরপর মায়ের দুধের মাধ্যমে এ রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জš§ালেও দু-তিন মাসের মধ্যে তা কমে যায়, তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে এ রোগের বিরুদ্ধে টিকা দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের ইপিআই কর্মসূচিতে পেন্টা ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
এগুলো ছাড়াও শিশুদের নানারকম সংক্রামক ব্যাধি হতে পারে। যেমন নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, সাধারণ সর্দি-কাশি, চোখের প্রদাহ প্রভৃতি। এছাড়া বর্তমান সময়ে বহুল আলোচিত ডেঙ্গু ও করোনাও শিশুদের আক্রান্ত করতে পারে। শিশুদের সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে টিকার পাশাপাশি মা-বাবার সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যশিক্ষা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নিউমোনিয়া, করোনা, ডেঙ্গু প্রভৃতি নিয়ে সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফিচার, জনসচেতনতামূলক বার্তা প্রভৃতি প্রকাশিত হয়। এগুলো আরও প্রচার করতে হবে। এছাড়া শিশুর পুষ্টির দিকটাও খেয়াল রাখা জরুরি, যেন তার নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভালো থাকে। ছয় মাসের কম বয়সী শিশুদের শুধু বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। যে শিশুর বয়স ছয় মাসের বেশি, তাদের বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার হিসেবে দেশীয় পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে, যাতে তাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সুগঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশের আপামর জনগণের কাছে মাতৃদুগ্ধের প্রয়োজনীয়তা, নারী ও শিশুস্বাস্থ্য প্রভৃতি বিষয়ে জনগণকে বিশেষভাবে সচেতন করছে।
তাছাড়া সুস্থ শিশুকে আক্রান্ত শিশুর কাছ থেকে দুরে রাখতে হবে। হাঁচি-কাশি আক্রান্ত মানুষ এবং ধুলাবালি থেকে শিশুদের দূরে রাখতে হবে। সবসময় শিশুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা চাই। বাসায় মুক্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে, কারণ বদ্ধ পরিবেশে নানা ধরনের সংক্রামক অসুখ হতে পারে। বাসা-বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বাইরে থেকে এসে হাত-মুখ সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এ অভ্যাসগুলো করোনা প্রতিরোধেও সহায়ক। এছাড়া খাবার খাওয়ার আগে অবশ্যই হাত ধুতে হবে। শীতকালে শিশুর গোসল, পান করা প্রভৃতি ক্ষেত্রে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করা উচিত। বর্ষাকালে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশার কামড় থেকে শিশুকে রক্ষা করতে হবে। অপরিণত বা স্বল্প ওজনের শিশুরা পরে খুব সহজেই নানা রোগে আক্রান্ত হয়, তাই গর্ভকালে মায়েদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে শিশু অপরিণত বা স্বল্প ওজনের না হয়। আর যদি কোনো শিশু অপরিণত বয়সে জ জন্ম নেয়, তাহলে তাদের ব্যপারে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
শিশুদের সব সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের জন্য সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে, মানুষকে প্রতিনিয়ত সচেতন করে যাচ্ছে। আমাদেরও সচেতন হতে হবে। সবাই মিলেমিশে কাজ করব; সুস্থ, সবল ও উন্নত জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবÑএটাই আমাদের কাম্য ও অঙ্গীকার। (শেষ)
পিআইডি নিবন্ধ