মোহাম্মদ অংকন :‘আপনার বাড়ি কোথায়’Ñএই প্রশ্নের উত্তরে যখন বলি নাটোরে, তখন স্বভাবতই প্রশ্নকর্তার মনের ভেতর কয়েকটি নাম বা চিহ্ন ভেসে ওঠে। যথাÑবনলতা সেন, চলনবিল, উত্তরা গণভবন। তবে সবচেয়ে বেশি যে নামটি মানুষের মনের ভেতর জেগে ওঠে, তা হলো কাঁচাগোল্লা। তারপরই আবদারটা করে বসেন, কবে খাওয়াচ্ছি নাটোরের বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা? মিষ্টি-মধুর এই আবদার কখনও-সখনও পূরণ করা হয়। কখনওবা পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো একটা কৌতুক আছে, নাটোরের মানুষ বলেই যে সারা দিন কাঁচাগোল্লা খাই, এমনটা ভাববেন না! যাহোক, এই যে কাঁচাগোল্লার বরাত দিয়ে আমাকে বা আমার শহরকে অন্য জেলার মানুষ সহজেই শনাক্ত করতে পারছে, এই শনাক্তকরণই হচ্ছে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই)।
‘ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হচ্ছে কোনো সামগ্রীর ব্যবহার করা বিশেষ নাম বা চিহ্ন। এই নাম বা চিহ্ন নির্দিষ্ট সামগ্রীর ভৌগোলিক অবস্থিতি বা উৎস (যেমন একটি দেশ, অঞ্চল বা শহর) অনুসারে নির্ধারণ করা হয়। ভৌগোলিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সামগ্রী নির্দিষ্ট গুণগত মানদণ্ড বা নির্দিষ্ট প্রস্তুত প্রণালি অথবা বিশেষত্ব নিশ্চিত করে।’ এই সংজ্ঞার সূত্র ধরে সহজেই অনুমেয় হয় যে কাঁচাগোল্লাও নির্দিষ্ট একটি শহরকে সুনির্দিষ্টভাবে উপস্থাপন করে আসছে। নাটোর ব্যতীত অন্য জেলার মানুষ তাদের পরিচয়কে জোরালো করতে কাঁচাগোল্লাকে জুড়ে দিতে পারছেন না। আবার এই কাঁচাগোল্লার গুণগত মানদণ্ড তথা স্বাদ নিয়ে মানুষের ইতিবাচক ‘রিভিউ’ আছে। সেইসঙ্গে এটির প্রস্তুত প্রণালিও একদম মৌলিক। কাঁচাগোল্লা পণ্যটি যেভাবে তৈরি করা হয়, তা অন্য কোনো মিষ্টি-মিষ্টান্ন তৈরির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশেষত্বের দিক দিয়েও এটি মৌলিকত্ব বহন করে। অর্থাৎ কোনো পণ্য ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যেসব মানদণ্ড লাগে, সেসব বিষয়ে কাঁচাগোল্লা উতরিয়ে আছে ইতোমধ্যে।
নাটোরের এই ঐতিহ্যবাহী কাঁচাগোল্লা সৃষ্টির পেছনে আছে প্রাচীন মিথ। একসময় নাটোর অঞ্চল ছিল রানী ভবানীর শাসনামল। তিনি মিষ্টি খেতে বেশ পছন্দ করতেন। শহরের লালবাজারের মিষ্টি বিক্রেতা মধুসূদন পাল রানীর রাজপ্রাসাদে নিয়মিত মিষ্টি সরবরাহ করতেন। হঠাৎ করেই একদিন তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সকল কর্মচারী কাজে আসে না। ওইদিন মিষ্টি-মিষ্টান্ন তৈরির জন্য দোকানে মণ দুয়েক দুধের ছানা রাখা ছিল। ছানাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে ভেবে মধুসূদন পাল দোকানে থাকা দুধের ছানার সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণ চিনি মিশিয়ে চুলায় তাপ দিতে থাকেন। একসময় গরম ছানা থেকে সুন্দর ঘ্রাণ বের হতে থাকে। মধুসূদনের নাকে সেই ঘ্রাণ যেতেই তিনি তা মুখে দিয়ে দেখেন যে খেতে দারুণ স্বাদ হয়েছে। এরপরই তার মাথায় আসে ভিন্ন এক বুদ্ধি। দুঃসাহস করেই হোক আর নতুনত্ব দেখাতে হোক, স্বাদে অতুলনীয় হওয়ায় নতুন এই মিষ্টি তিনি রানী ভবানীর রাজপ্রাসাদে নিয়ে যান। বিধিবাম, এই ছানার কাঁচা মিষ্টি খেয়ে রানী প্রশংসায় পঞ্চমুখ করে তোলেন। এই খাবারের নাম কী, তা জানতে মধুসূদনকে জিজ্ঞেসও করেন তিনি।
মধুসূদন পাল ছিলেন প্রত্যুৎপন্নমতি। কাঁচা ছানা থেকে তৈরি করা হয়েছে বলে এর নাম বলেন কাঁচাগোল্লা। ধীরে ধীরে কাঁচাগোল্লার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে রাজপ্রাসাদে। পরে তা সাধারণ মানুষের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে কাঁচাগোল্লা এক অনন্য ইতিহাস হয়ে উঠল। তাই কাঁচাগোল্লা বললেই মানুষ সহজে বোঝে নাটোরের অনন্য স্বাদের মিষ্টির কথা। কাঁচাগোল্লার জন্য গর্ববোধ করেন নাটোরবাসী। শুধু নাটোরে উৎপন্ন হয় বলেই যে নাটোরবাসী কাঁচাগোল্লাকে নিয়ে এত গর্ববোধ করে, তা কিন্তু নয়। যে কাঁচাগোল্লার কথা বললে নিজের জš§-অঞ্চলকে আর নতুন করে কোনো বিশেষণে বিশেষায়িত করার প্রয়োজন মনে করতে হয় না, সেই কাঁচাগোল্লাকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃত করার বিষয়ে নাটোরের মানুষ দাবি তুলে আসছে অনেক আগে থেকেই। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এ বিষয়ে তেমন কোনো জোরালো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। কিংবা ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতি দাতা প্রতিষ্ঠানের নজরে আসেনি এই পণ্যটি।
নাটোরের কাঁচাগোল্লার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের অত্রাঞ্চলের আপামর মানুষের আবেগ, ভালোবাসা ও স্মৃতি। প্রায় আড়াইশো বছর আগে প্রথম তৈরি হলেও আজও মিষ্টির সুনাম ধরে রেখেছেন কারিগর ও বিক্রেতা-প্রতিষ্ঠানগুলো। নাটোর অঞ্চলের যে কোনো বিয়ে, বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান ও অতিথি আপ্যায়নে সরবরাহ করা হয় কাঁচাগোল্লা। নাটোরে আসা দর্শনার্থীরাও কাঁচাগোল্লার স্বাদ লুফে নেন। মিষ্টির দোকানিরা প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাঁচাগোল্লা পাঠান। কাঁচাগোল্লাকে কেন্দ্র করে চলে নাটোরের মিষ্টির বড় ব্যবসা। এত কিছুর পরও দুঃখজনক আরেকটি বিষয় সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের নজরে আসছে। তা হলো নকল কাঁচাগোল্লার ভিড়ে চাপা পড়ছে ঐহিত্যবাহী কাঁচাগোল্লা। বিশেষ করে গণপরিবহন, ট্রেনে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রতারক চক্র কম মূল্য দেখিয়ে নকল কাঁচাগোল্লা তুলে দিচ্ছে ভ্রমণরত মানুষদের হাতে। যারা কিনা তা খেয়ে অনেকাংশে কাঁচাগোল্লার খোদ দুর্নাম করছে। যেহেতু ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বিভিন্ন সামগ্রী নির্দিষ্ট অঞ্চলটিতে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করার অধিকার এবং আইনি সুরক্ষা প্রদান করে, সেহেতু কাঁচাগোল্লা ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেলে কাঁচাগোল্লার নকল রোধ করা সম্ভব হবে। সেইসঙ্গে সেই পুরোনো ঐহিত্যবাহী স্বাদ ও তৈরির প্রণালি টিকিয়ে রাখার বিষয়ে উৎপাদন ও বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলো সচেতন হবে বলে বিশ্বাস করি।
বাংলাদেশে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া বা চাওয়ার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। ইতোমধ্যে ১৫টি জিনিস বা পণ্য ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে ১৭ নভেম্বর ২০১৬ সালে জামদানি স্বীকৃতি পায়। সে সময় উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে পুরো বাংলাদেশ। এরপর ৬ আগস্ট ২০১৭ পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশকে বাংলাদেশী পণ্য হিসেবে বিশ্ব স্বীকৃতি অর্জনের কথা ঘোষণা করে। এর ফলে ইলিশ বাংলাদেশের দ্বিতীয় ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত হয়। ২৭ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে ক্ষীরশাপাত আমকে খাদ্যদ্রব্য বিভাগে বাংলাদেশের ৩য় ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর মসলিনকে বাংলাদেশের চতুর্থ ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল রাজশাহী সিল্ককে ৫ম, শতরঞ্জিকে ষষ্ঠ, চিনি গুঁড়া চালকে ৭ম, দিনাজপুরের কাটারিভোগকে ৮ম এবং বিজয়পুরের সাদা মাটিকে ৯ম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
২০২২ সালের ২৪ এপ্রিল বাগদা চিংড়িকে বাংলাদেশের ১০ম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য বলে আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধন সনদ দেওয়া হয়। একই বছর বাংলাদেশের একাদশতম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় রাজশাহীর বিখ্যাত ফজলি আম। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৫ জুলাই আরও চারটি পণ্যকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পণ্যগুলা যথাক্রমে, বগুড়ার বিখ্যাত দই, শেরপুরের তুলসীমালা ধান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম ও আশ্বিনা আম। ১৬তম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি হিসেবে নাটোরের কাঁচাগোল্লাকে দেখতে উৎসুক আমরা। এটি এখন আমাদের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। গণমানুষের এই দাবিকে কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়াও জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের বদৌলতে চলতি বছরের শুরুর দিকে একটি আওয়াজ কানে এসেছিল যে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পেতে পারে নাটোরের কাঁচাগোল্লা। ইতোমধ্যে নিবন্ধনের উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। নাটোরের জেলা প্রশাসক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘নাটোরের কাঁচাগোল্লাকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে নিবন্ধনের উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। এরই অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে নিবন্ধনের আবেদন করা হয়েছে। এছাড়া এফিডেভিটের মাধ্যমে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) বরাবর আবেদন পাঠানো হয়েছে।’ জেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগ যদি সত্যি স্বীকৃতিদাতা কর্তৃপক্ষ আমলে নিয়ে কাজ শুরু করে, তবে খুব শিগগিরই কাঁচাগোল্লা ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পেতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস রাখতে পারি। তবে যতদিন না আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিটি কাঁচাগোল্লা পাচ্ছে না, ততদিন আমাদের দাবিকে তাচ্ছিল্য করে থামিয়ে রাখার কোনো সুযোগ নেই। আমরা জেলা প্রশাসককেও বিনীত অনুরোধ করব, বিষয়টির অগ্রগতি কতদূর, তা দেখভাল করার জন্য।
এটি বলার কোনো অপেক্ষা রাখে না যে নাটোরের কাঁচাগোল্লা সারাদেশে প্রসিদ্ধ ও এর যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। শুধু তাই নয়, কাঁচাগোল্লা ভারতসহ বিভিন্ন দেশেও রপ্তানি করা হয়ে থাকে। তাই কাঁচাগোল্লাকে দ্রুত ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতিকরণের মধ্য দিয়ে নাটোরের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি দেশ-বিদেশে কাঁচাগোল্লার চাহিদা আরও বাড়ানোর বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়াও জরুরি হয়ে পড়েছে। সেইসঙ্গে কাঁচাগোল্লার নকল প্রতিরোধে জেলা প্রশাসনকে তৎপর হওয়ার আহ্বান করছি। স্বাভাবিক মূল্যের চেয়ে বেশি দামে যাতে বিক্রি করা না হয় ও নকল কাঁচাগোল্লা বাজারে যাতে না আসে, এ বিষয়ে ভোক্তা অধিদপ্তরকে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ করছি। শেষ কথা এই যে নাটোরের কাঁচাগোল্লাকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে ঘোষণা করা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে এখন।
প্রকৌশলী