নানা সমস্যায় জর্জর বরিশাল বিমানবন্দর

আরিফ হোসেন, বরিশাল: ঢাকা-বরিশাল বিমানপথে যাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে যাত্রীদের পোহাতে হচ্ছে নানা দুর্ভোগ। গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গাটিতে ধারণক্ষমতা কম থাকায় মূল সড়কে নেমে যেতে হয় যাত্রীদের। উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণের কারণে যাত্রীদের ভিড় সামলাতে প্রতিনিয়ত হিমশিম পোহাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। অনেক সময় যাত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করা রীতিমতো কঠিন হয়ে পরে। এ কারণে দুর্ভোগে পড়েন সংশ্লিষ্ট সবাই।

বরিশাল বিমান বন্দর সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন পাঁচটি ফ্লাইট বরিশাল-ঢাকা রুটে চলাচল করে। এর মধ্যে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট প্রতিদিন সকালে চলাচল করে। আর বৃহস্পতিবার বিকালেও বাংলাদেশ বিমানের অতিরিক্ত একটি ফ্লাইট চলাচল করে। এদিকে ১ নভেম্বর থেকে বরিশাল নগরীর সেলস অফিস থেকে বরিশাল বিমানবন্দরে যাত্রীদের আনা নেয়ার লক্ষ্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস চালু করছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।

এছাড়া ইউএস বাংলার দুটি ও নভএয়ারের দুটি ফ্লাইট প্রতিদিন চলাচল করে।

ঢাকা বরিশাল বিমানপথে প্রতিদিন প্রায় ২৫০ যাত্রী যাতায়াত করেন। তবে ঢাকা থেকে বরিশালে আসা যাত্রীর সংখ্যা বেশি বলে জানিয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষ। একটি সূত্র জানিয়েছে, যাত্রীদের বেশিরভাগই ভিআইপি। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতার আগমন ও পরিগমনের সময় নেতাকর্মীদের ভিড় সামলানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এছাড়া প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও এ ধরনের ঘটনা ঘটে।

যাত্রীদের দুর্ভোগের মধ্যে রানওয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। দেখা গেছে, নানা সময় রানওয়েতে অনধিকার প্রবেশ করে লোকজন। এছাড়া পশুও প্রবেশ করে অহরহ। কয়েকদিন আগে রানওয়েতে কুকুরের বিচরণ লক্ষ্য করা গেছে। বিমানবন্দরের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম অংশে রানওয়ের সীমানা প্রাচীর ভেঙে রানওয়ের ওপর দিয়ে স্থানীয় জনসাধারণের চলাচলের জন্য রাস্তা উম্মুক্ত করায় সেখান থেকে অবাধে গরু ছাগলও প্রবেশ করছে। রানওয়ের ওপর দিয়েও নির্বিঘ্নে চলাচল করছে এসব প্রাণী। আর সীমানা প্রচীরের মধ্যে রানওয়ের পাশের বিশাল চারণভূমিতে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা ঘুরে বেড়াচ্ছে গরু ছাগল।

সমস্যার অন্ত নেই

দীর্ঘ ৩৬ বছরেও পূর্ণতা পায়নি দক্ষিণাঞ্চলবাসীর একমাত্র বরিশাল বিমানবন্দর। নানা সমস্যায় জর্জর এ বিমানবন্দর। প্রতিদিন পাঁচটি ফ্লাইট চলাচল করলেও বরিশাল বিমানবন্দরের উন্নয়ন-সম্প্রসারণ কিংবা আধুনিকীকরণসহ সবকিছু রহস্যজনক কারণে থমকে রয়েছে।

বিমানবন্দরের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল বিমানবন্দরে ১২২ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদ থাকলেও কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৬০ জন। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসন ভবনগুলোর অবস্থাও করুণ। নতুন ভবন নির্মাণ করা হলেও বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়নি। তবে জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট রানওয়ের বিমানবন্দর এটি। এখানে রানওয়ের দৈর্ঘ্য মাত্র ছয় হাজার ফুট। এত ছোট রানওয়েতে অভ্যন্তরীণ রুটের বিমানের উড্ডয়ন-অবতরণে কষ্ট হয়। এখানে বড় উড়োজাহাজ ওঠানামা প্রায় অসম্ভব। রানওয়ে এতো ছোট যে, পাশাপাশি দুটি উড়োজাহাজের অবস্থান করাও অসুবিধার। এখানকার অ্যাপ্রোনের আকার ২০০ ফুট প্রস্থ ও ২৫০ ফুট দৈর্ঘ্যরে। ২০০৭ সালে সিডরের তাণ্ডবে দক্ষিণ উপকূল বিধ্বস্ত হলে ছোট রানওয়ের জটিলতা বড় হয়ে দেখা দেয়। সে সময় ত্রাণ পরিবহনের কাজে বিমানবন্দরটি ব্যবহƒত হলেও রানওয়ে ছোট হওয়ায় বিদেশি অনেক বিমান এখানে নামতে পারেনি। ফলে ঢাকায় ত্রাণ নামিয়ে তা দক্ষিণাঞ্চলে পাঠাতে হয়েছে।

বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় প্রতি বছর ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হয়। এ রকম ক্ষেত্রে জরুরি সহায়তার বিষয়টি মাথায় রেখে হলেও দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র বিমানবন্দরটির রানওয়ে বড় করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

তিনি আরও বলেন, এখানে যে টার্মিনাল ভবন রয়েছে, সেটিও বেশ পুরোনো। দৈনিক পাঁচটি ফ্লাইটে আসা-যাওয়া করা যাত্রীদের জন্যও এটি অপ্রতুল। তাই তিনি দক্ষিণাঞ্চলবাসীর একমাত্র বিমান বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের পাশাপাশি যাত্রীসেবার মান বাড়াতে জরুরি ভিত্তিতে বিমানবন্দরের উন্নয়ন-সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি।

বরিশাল বিভাগ উন্নয়ন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মো. আতিকুর রহমান আতিক বলেন, নিরাপত্তা বিবেচনায় দক্ষিণাঞ্চলের এ বিমানবন্দরটি একেবারে অরক্ষিত। চারপাশে সীমানা প্রাচীর থাকলেও কয়েকস্থান ভেঙে গেছে। আবার কিছু স্থানে প্রাচীরের নিচে মাটি না থাকায় ফাঁকা স্থান দিয়ে হুটহাট লোকজন ঢুকে পড়ছে রানওয়েতে। এ অবস্থায় বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বন্দরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। বিশেষ করে বন্দরের রহমতপুর থেকে বাবুগঞ্জ যাওয়ার সড়কে অংশে নিরাপত্তা প্রাচীর খুবই অরক্ষিত।

সিভিল এভিয়েশনের প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইটিএও) নীতিমালা অনুযায়ী যে কোনো বিমানবন্দরে রানওয়ের কেন্দ্র থেকে দু’দিকে কমপক্ষে ৫০০ ফুটের মধ্যে কোনো স্থাপনা থাকতে পারবে না। কিন্তু এখানে ২০০ ফুটের মধ্যে নিরাপত্তা বেষ্টনী রয়েছে। এছাড়া ১৬০ একর জমির ওপর নির্মিত বিমানবন্দরটি নিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আইটিএও’র সুপারিশ অনুযায়ী, রানওয়ে সম্প্রসারণসহ অবকাঠামোগত ঝুঁকি দূর করতে এর আয়তন ৩২৫ একর বাড়াতে হবে।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, এখানে বিমান ওঠানামায় ব্যবহƒত ল্যান্ডিং ইকুইপমেন্টও আধুনিক নয়। বিমানের এক পাইলট জানান, আইএলএস থাকলে শীত মৌসুমে ঘনকুয়াশা কিংবা পাইলট অসুস্থবোধ করলেও অটো পাইলটে খুব সহজে বিমান অবতরণ করতে পারেন। দেশের যেসব বিমানবন্দরে এখনও আইএলএস নেই, সেখানে অন্তত ডিভি ওয়্যার আছে। এ সিস্টেমেও বিমান উড্ডয়ন কিংবা অবতরণে খুব একটা সমস্যা হয় না। বরিশাল বিমানবন্দরে যে সিস্টেম রয়েছে তা পুরোনো হওয়ায় অনেক সময় উড্ডয়ন ও অবতরণে মানসিক চাপে পড়তে হচ্ছে।

জানা গেছে, দেশের প্রায় সব বিমানবন্দরে বর্তমানে উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের কাজ চলছে। এসব কাজে সরকার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বরিশাল বিমানবন্দর মেরামত ও সংস্কারের জন্য কিছু টাকা দেয়া হয়েছিল। এরপর আর কোনো বরাদ্দ আসেনি।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলেন, আইএলএস সিস্টেম বাংলাদেশের কোনো বিমানবন্দরে নেই। এছাড়া বরিশাল বিমানবন্দরে বর্তমানে যে সিস্টেম রয়েছে, একে খুব বেশি পুরোনো বলা যাবে না। আমরা বর্তমানে সেখানে পারফরম্যান্স বেজড ল্যান্ডিং সিস্টেম চালু করেছি। এটা যথেষ্ট আধুনিক। এ সিস্টেমে উড্ডয়ন ও অবতরণে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেন বলেন, বরিশাল বিমানবন্দর সম্প্রসারণসহ আধুনিকীকরণের পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে এ-সংক্রান্ত জরিপ হলেও কভিডের কারণে কাজে কিছুটা ধীরগতি তৈরি হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সিভিল এভিয়েশনে শিগগির দেড় হাজারের বেশি লোক নিয়োগ দেয়া হবে।

উল্লেখ্য, আকাশ থেকে শস্য ক্ষেতে কীটনাশক ছিটানোর কাজে ব্যবহারের জন্য ১৯৬৩ সালে বরিশাল নগরী থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরত্বের বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নে ‘প্লান্ট প্রোটেকশন’ বন্দর হিসেবে দুই হাজার ফুট রানওয়ে নির্মাণ করা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৮৫ সালে একে বিমানবন্দরে রূপান্তর করা হয়। এরপর ১৯৯৫ সালের ১৭ জুলাই থেকে দিনে ঢাকা-বরিশাল রুটে বাণিজ্যিক বিমানের চলাচল শুরু হয়।