Print Date & Time : 15 September 2025 Monday 8:51 pm

নামমাত্র ডিভিডেন্ড দিয়ে কোম্পানির প্রতারণা

শেখ আবু তালেব ও আসাদুজ্জামান নূর: বছর শেষে বিনিয়োগকারীদের মাত্র শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে টানা লোকসানে থাকা খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড (কেপিপিএল)। এ পরিমাণ লভ্যাংশ দিয়ে ‘জেড’ থেকে ‘বি’ ক্যাটেগরিতে এসেছে কোম্পানিটি। ফলে বাড়ছে কোম্পানিটির শেয়ারদর। ৩০টি কোম্পানি এ সুযোগ নিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নীরব ভ‚মিকায় এমন ধারা শুরু হয়েছে সম্প্রতি। ক্যাটেগরি পরিবর্তনের এমন সুযোগ শেয়ার কারসাজির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এক ও দুই শতাংশ দিয়ে ‘ক্যাটেগরি’ পরিবর্তন করা কোম্পানির সংখ্যা ৩০টি। এর মধ্যে এক শতাংশ লভ্যাংশ দেয়া কোম্পানি ১৬টি। এভাবে এক শতাংশের বেশি ও দুই শতাংশের নিচে লভ্যাংশ দেয় কোম্পানির সংখ্যা হচ্ছে ৪টি। শুধু দুই শতাংশ মুনাফা দিয়েছে এমন কোম্পানির সংখ্যা হচ্ছে ১০টি।

জানা গেছে, বছর শেষে বিনিয়োগকারীদের কত শতাংশ হারে লভ্যাংশ দিতে হবে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো বাধ্যবাধকতা নেই এ-সংক্রান্ত নীতিমালায়। এ শিথিলতার সুযোগে নামমাত্র লভ্যাংশ দিয়ে ক্যাটেগরি পরিবর্তন করছে কিছু কোম্পানি। কেপিপিএলের মতো এসব কোম্পানির শেয়ারের ক্রেতাদের বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিশেষভাবে নজরদারি করা উচিত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত নামমাত্র লভ্যাংশ দেয়ার সুযোগ বন্ধ করে দেয়া।

‘জেড’ ক্যাটেগরি থেকে ‘বি’তে চলে আসা কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দর নিয়ে কারসাজি হচ্ছে বলেও মনে করেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবু আহমেদ। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘লোকসানি কোম্পানির শেয়ার ক্রেতারা কথিত বিনিয়োগকারী। তাদের শনাক্ত করা উচিত। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত এসব কোম্পানির শেয়ার ক্রেতাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা। আর শেয়ার কারসাজির কোনো উপকরণও কারও হাতে তুলে দেয়া উচিত নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত হবে ক্যাটেগরি পরিবর্তনের নিয়মে সংস্কার আনা। ১০ শতাংশের নিচে ডিভিডেন্ড দিলে তাদের ক্যাটেগরি পরিবর্তন করা সমীচীন নয়।’

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, দেশের এ প্রধান পুঁজিবাজারে কাগজ ও মুদ্রণ খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানি কেপিপিএল। কোম্পানিটি গত চার বছর ধরে টানা লোকসান গুনছে। ২০২০ সালের জন্য বিনিয়োগকারীদের কোম্পানিটি শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়। লোকসানে থাকায় এ পরিমাণ লভ্যাংশ রিটেইন আর্নিং তথা রিজার্ভ থেকে দেয়।

লভ্যাংশ ঘোষণার পর শেয়ারের দর বাড়তে থাকে কেপিপিএলের। গত ২১ মে কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ১১ টাকা ৫০ পয়সা। ৩০ সেপ্টেম্বর শেয়ারটি হাতবদল হয়েছে ১৫ টাকা ৪০ পয়সায়। সর্বশেষ লেনদেন হয় ১৪ টাকা ৪০ পয়সায়। এর মাঝে শেয়ারটি হাতবদল হয়েছে সর্বোচ্চ ১৭ টাকা ২০ পয়সায়।

কোম্পানির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে কেপিপিএলের লোকসান হয়েছে দুই কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর আগে ২০১৯ সালে লোকসান ছিল ১৭ কোটি ১১ লাখ টাকা, ২০১৮ সালে আট কোটি ৯৪ লাখ টাকা ও ২০১৭ সালে লোকসান দেয় আট কোটি ৯৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা। ক্রমাগত লোকসানের কারণে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি।

এতে কোম্পানিটি ‘জেড’ ক্যাটেগরি বা জাঙ্ক শেয়ারের তালিকায় চলে যায়। এ তালিকা থেকে বের হতে ২০১৯ সালে মাত্র এক শতাংশ ও ২০২০ সালে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয় বিনিয়োগকারীদের। বিনিয়োগকারীরা বলছেন, লোকসান জেনেও শেয়ার ক্রেতারা প্রকৃতপক্ষে বিনিয়োগকারী নন। তারা কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দর বাড়িয়ে চলেছেন। এ ক্ষেত্রে কোম্পানির ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িতদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা কারসাজি করছেন।

বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, এভাবে নামমাত্র লভ্যাংশ ঘোষণা করে কোম্পানি সংশ্লিষ্টরাই বাজারে গুজব ছড়ানো শুরু করে। প্রচার করা, কোম্পানির ব্যবসায় পরিবর্তন আসছে, নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এমন গুজবে ভর করে অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ারটি কেনেন। অবশেষে শেয়ারের দর বাড়লে বিক্রি করে সটকে পড়েন কোম্পানির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা। এভাবে একটি শ্রেণি বছরের পর বছর শেয়ার কারসাজি করে চলেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে কেপিপিএলের কোম্পানি সচিব মো. মিলন খান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘কোম্পানির লোকসান থাকা সত্তে¡ও লভ্যাংশ দিতে পেরেছে রিটেইন আর্নিং থেকে। এটি পুঁজিবাজারের নিয়মসিদ্ধ।’

লোকসান থাকার পরও কেন নগদ লভ্যাংশ দেয়া হলোÑএমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ক্যাটেগরি পরিবর্তনসহ কোম্পানির সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’ সহসাই কোম্পানি লাভের মুখ দেখতে পারবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, ‘কবে মুনাফায় ফিরবে, তা বলা যাচ্ছে না।’

তথ্য বলছে, এবার এক শতাংশ লভ্যাংশ দেয়া কোম্পানির সংখ্যা হচ্ছে ১৬টি। ২০২০ সালের জন্য শুধু এক শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে ফার কেমিক্যাল, কেয়া কসমেটিকস, স্যালভো কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি, মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ, ইনটেক লিমিটেড, আজিজ পাইপস, ঢাকা ডায়িং, মোজাফ্ফর হোসেন স্পিনিং মিলস, প্রাইম টেক্সটাইল স্পিনিং মিলস, শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, ইয়াকিন পলিমার, স্ট্যান্ডার্ড সিরামিক, সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেড।

এভাবে এক শতাংশের বেশি ও দুই শতাংশের নিচে লভ্যাংশ দেয়া কোম্পানির সংখ্যা হচ্ছে ২০টি। ২০২০ সালের জন্য বিনিয়োগকারীদের এক শতাংশের বেশি কিন্তু দুই শতাংশের নিচে মুনাফা দেয়া কোম্পানি হচ্ছে ফু-ওয়াং ফুড। কোম্পানিটি মুনাফা দিয়েছে এক দশমিক ৬৫ শতাংশ। একইভাবে ভ্যানগার্ড এএমএল, রূপালী ব্যাংক ব্যালান্সড ফান্ড এক দশমিক ছয় শতাংশ, ফু-ওয়াং সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ এক দশমিক চার শতাংশ মুনাফা দিয়েছে বিনিয়োগকারীদের। শুধু দুই শতাংশ মুনাফা দিয়েছে এমন কোম্পানির সংখ্যা হচ্ছে ১০টি।

বিষয়টিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘ক্যাটেগরি পরিবর্তনের সব তথ্যই বিনিয়োগকারীরা অবগত রয়েছেন। এরপরও যদি কোনো শেয়ার কারসাজির লক্ষণ দেখা যায় আমরা ব্যবস্থা নেব।’