ইসমাইল আলী:জ্বালানি সংকটে গত বছর জুলাই থেকে আনুষ্ঠানিক লোডশেডিং শুরু হয়। ওই সময় তেলচালিত বেশকিছু রেন্টাল ও আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) বন্ধ হয়ে যায়। গ্যাস সংকটেও বেশকিছু কেন্দ্র আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ। এর মধ্যে গত এপ্রিলে রোজায় অস্বাভাবিক গরমে লোডশেডিং চরম আকার ধারণ করে। তবে চুক্তির শর্তের কারণে বেসরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ পুরোটাই দিতে হয়েছে। ফলে প্রচুর অর্থ গচ্চা গেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি)।
বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের এপ্রিলের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, গত এপ্রিলে অন্তত ২০টি কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ব্যবহার হয় শূন্য থেকে ২৫ শতাংশ। অথচ এসব কেন্দ্রে পূর্ণ ক্ষমতার ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে। ফলে এসব কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়েছে ২০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা নতুন বিদ্যুৎ ও প্যারামাউন্ট বিট্র্যাক কেন্দ্র দুটির। পুরো এপ্রিল জুড়েই কেন্দ্র দুটি বন্ধ থাকলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়েছে।
ভারতের শাপুরঝি-পালনঝি গ্রুপের নতুন বিদ্যুৎ (বাংলাদেশ) লিমিটেড কেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা ২২০ মেগাওয়াট। গ্যাস সংকটে এপ্রিলে এতে কোনো বিদ্যুৎই উৎপাদন করা হয়নি। অথচ বসিয়ে রেখেই ৩২ কোটি ৫১ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়েছে। একই অবস্থা বাংলাদেশের প্যারামাউন্ট বিট্র্যাক কেন্দ্রটির। ডিজেলচালিত ২০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি এপ্রিলে পুরোপুরি বন্ধ ছিল। অথচ ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে ৩৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। আর ডিজেলচালিত ১০০ মেগাওয়াট বাংলা ট্র্যাক-২ কেন্দ্রটি চলেছে মাত্র এক দশমিক ১৮ শতাংশ। তবু ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ১০ টাকা ৫৪ পয়সা।
এনার্জিপ্যাক (ইপিভি) ঠাকুরগাঁও ১১৫ মেগাওয়াট কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ফার্নেস অয়েল সংকটে চলেছে মাত্র সাত দশমিক ৫৭ শতাংশ। কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ১০ কোটি ৯ লাখ টাকা। ফার্নেস অয়েলচালিত ইপিসিভি চট্টগ্রাম ১০৮ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি চলেছে আট শতাংশের কিছু বেশি। তবে এ কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ১০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। গ্যাসচালিত ৫৫ মেগাওয়াটের প্রিসিশন এনার্জি কেন্দ্রটি চলেছে আট দশমিক ৭০ শতাংশ। কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে আট কোটি ২০ লাখ টাকা। ডিজেলচালিত বাংলা ট্র্যাক-১ কেন্দ্রটির সক্ষমতা ২০০ মেগাওয়াট। মাত্র ৯ শতাংশ সময় চললেও ৩২ কোটি ২২ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে।
কয়লাচালিত ৩০৭ মেগাওয়াটের বরিশাল ইলেকট্রিক কেন্দ্রটি চলেছে ১২ দশমিক ৮১ শতাংশ। তবে এ কেন্দ্রটির জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে ৭৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ফার্নেস অয়েলচালিত রাজ-লঙ্কা পাওয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সক্ষমতা ৫২ মেগাওয়াট। এটি এপ্রিল মাসে চলেছে ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ। তবে এ সময়ের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে এক কোটি ৮৪ লাখ টাকা। ফার্নেস অয়েলচালিত ১১০ মেগাওয়াট সামিট বরিশাল কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ১৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। যদিও এ কেন্দ্রটি চলেছে ১৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ। আর ১৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ চলেছে মানিকগঞ্জ পাওয়ার। ফার্নেস অয়েলচালিত এ কেন্দ্রের জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে চার কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
ডিজেলচালিত বিদেশি মালিকানাধীন দুই কেন্দ্র এগ্রিকো ও এপিআর এনার্জি চলেছে যথাক্রমে ১৬ দশমিক ২১ ও ১৬ দশমকি ৫৩ শতাংশ। ১০০ ও ৩০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ দুই কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে যথাক্রমে ১৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ও ৫৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এগ্রিকোর অপর কেন্দ্রটি চলেছে আরও কম, ১৫ দশমকি ৭৪ শতাংশ। ১০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ১৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
গ্যাসচালিত কুশিয়ারা পাওয়ারের সক্ষমতা ১৬৩ মেগাওয়াট। যদিও এটি চলেছে ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তারপরও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ১২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ফার্নেস অয়েলচালিত ওরিয়নের রূপসা কেন্দ্রটি চলেছে ১৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। ১০০ মেগাওয়াট এ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ ১২ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ১৫০ মেগাওয়াট ফার্নেস অয়েলচালিত ইউনাইটেড পায়রা কেন্দ্রটি এপ্রিলে চালু ছিল ২০ দশমিক ৬৩ শতাংশ সময়। তবে এ কেন্দ্রের জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ১৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
ফার্নেস অয়েলচালিত অপর কেন্দ্র মেসার্স বাঙ্কো এনার্জি কেন্দ্রটি চলেছে ২০ দশমিক ৬০ শতাংশ। ৫৫ মেগাওয়াট এ কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ৯ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। একই জ্বালানিচালিত বারাকা পতেঙ্গার উৎপাদন সক্ষমতা ৫০ মেগাওয়াট। ২১ দশমিক ৩৬ শতাংশ সময় চললেও এ কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে চার কোটি ১৩ লাখ টাকা। ঠিকই একইভাবে ১১৩ মেগাওয়াট এইচপি পাওয়ার এপ্রিল মাসে চলেছে ২৩ দশমিক ২০ শতাংশ। তবে এ কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে ১৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ২০ কেন্দ্রে পিডিবির ক্যাপাসিটি চার্জ গেছে ৪০০ কোটি টাকার বেশি।
সূত্র জানায়, ডলার সংকটে চলতি অর্থবছর বেসরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারেনি। ফলে জ্বালানি তেল সংকটে বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রে আংশিক উৎপাদন হয়। এছাড়া সরকার ভর্তুকির অর্থ নিয়মিত ছাড় না করায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিল নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না পিডিবি। গ্যাস সংকটেও বিভিন্ন সময় বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়। তবে উৎপাদন বন্ধ থাকলেও এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ কাটা যাবে না।
চুক্তি অনুযায়ী, বছরে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রাখতে পারে রেন্টাল ও আইপিপিগুলো। অর্থাৎ ৯০ শতাংশ সময় উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত রাখতে হয় কেন্দ্রগুলো, যাতে পিডিবি চাহিদা দেয়া মাত্র তারা উৎপাদন করতে পারে। তাই ৯০ শতাংশ সময় সরকার বিদ্যুৎ না কিনলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। তবে কোনো কারণে উৎপাদন করতে না পারলে ক্যাপাসিটি চার্জ কেটে রাখা হয়। যদিও গত অর্থবছর ডলার সংকটে এসব কেন্দ্র চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেনি। তবুও চুক্তির শর্তের কারণে পুরো ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে। এতে বড় ধরনের গচ্চা গেছে পিডিবির।