নারায়ণগঞ্জে অবাধে গড়ে উঠেছে ডায়িং কারখানা

আবদুর রহিম, নারায়ণগঞ্জ: ভূপৃষ্ঠের হঠাৎ পরিবর্তনকে ভূমিকম্পের অন্যতম কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করেন আবহাওয়াবিদরা। আর পরিবেশবিদদের মতে, এই পরিবর্তনের মধ্যে অন্যতম হলো পানির স্তর নি¤œমুখী হওয়া। অর্থাৎ ভূগর্ভের পানির স্তর যত তলানিতে যাবে, ভূমিকম্পের শঙ্কা জাগবে ততটাই। এর মাঝেই নারায়ণগঞ্জে অনুভূত হয়েছে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প। এতে ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া না গেলেও শঙ্কা জেগেছে বিশ্লেষকদের মাঝে। তথ্য বলছে, শিল্পাঞ্চল অধ্যুষিত এই জেলায় উপর্যুপরি ডাইং কারখানা গড়ে ওঠায় ভূগর্ভ থেকে অবাধে তোলা হচ্ছে পানি। ফলে পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নিচে নামছে। ভূগর্ভের পানি শুষে নেয়ায় পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাবসহ ভয়াবহ ভূমিকম্পের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জে প্রতিবছর ভূগর্ভের সুপেয় পানির স্তর পরিমাপ বা নির্ণয় করে থাকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। দপ্তরটির সদর উপজেলার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বছরের মার্চ মাসে ভূগর্ভের পানির স্তর নির্ণয় করেন তারা। তাদের মতে, গোটা দেশের সমীকরণে প্রতিবছর গড়ে এক ফুট করে পানির স্তর নিচে নামাটা স্বাভাবিক হলেও নারায়ণগঞ্জে এর পরিসংখ্যানটা অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
দপ্তরটির দেয়া এক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সালের মার্চ থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত মাত্র এক বছরের ব্যবধানে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লা, কুতুবপুর, এনায়েতনগর ও কাশিপুরসহ আশপাশের অঞ্চলে গড়ে ১০ ফুট করে নিচে নেমেছে পানির স্তর!
জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপ বলছে, ‘২০২১ সালে এনায়েতনগর ইউনিয়নে সুপেয় পানি মিলত ১৭৫ ফুট গভীরে। তবে ২০২২ সালে আরও ১৩ ফুট নিচে নেমে ১৮৮ ফুটে মিলছে এ অঞ্চলের সুপেয় পানি। একই সময়ে ১০ ফুট গভীরে নেমে ২০০ ফুট নিচে মিলছে ফতুল্লা ইউনিয়নের ভূগর্ভের পানি। আর কাশিপুরে পানির স্তর নেমেছে ছয় ফুট গভীরে। বর্তমানে এই ইউনিয়নে সুপেয় পানির স্তর ১৭১ ফুট নিচে। ২০২৫ সালে এসব অঞ্চলে সুপেয় পানির স্তর নি¤œমুখী হওয়ার হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে সূত্রটি।

জরিপে দেখা গেছে, সুপেয় পানির স্তর সবচেয়ে বেশি নি¤œমুখী হয়েছে কুতুবপুরে। ইউনিয়নটিতে সুপেয় পানি মিলছে ২৫০ ফুট গভীরে! কোথাও কোথাও ২৫০ ফুটেও তা পাওয়া যাচ্ছে না। শিল্পাঞ্চল-অধ্যুষিত নারায়ণগঞ্জের ভূগর্ভের এই চিত্রকে উদ্বেগজনক হিসেবে আখ্যায়িত করছেন পরিবেশবিদরা। দায়িত্বশীলরা বলছেন, এই জেলায় ভূগর্ভের সুপেয় পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নিচে নেমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো মাত্রাতিরিক্ত ডাইং কারখানা। প্রতিটি ডাইং থেকে দৈনিক একাধিকবার বিপুল পরিমাণে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে ভূগর্ভ থেকে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার মধ্যে ফতুল্লা, কুতুবপুর, এনায়েতনগর ও কাশিপুর ইউনিয়ন শিল্পকারখানা অধ্যুষিত অঞ্চল। এসব অঞ্চলে গড়ে ওঠা ডাইং কারখানাগুলোর পানির চাহিদা মেটানো হচ্ছে ভূগর্ভ থেকে। এতে ভূগর্ভের পানির ওপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এসব অঞ্চলে আশঙ্কাজনক হারে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে।’

পরিবেশবাদী আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট এবি সিদ্দিক বলেন, ‘একটি বাড়িতে ডিপ মোটরের মাধ্যমে যে পরিমাণ পানি উত্তোলন হয়, প্রতি ঘণ্টায় তার চেয়ে কয়েক লাখ গুণ বেশি পানি উত্তোলন করে বিভিন্ন ডাইং কারখানা। ২০১৩ সালের দিকে এ বিষয়ে তীব্র আন্দোলন করেছিলাম। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও কারওয়ান বাজার মিলে ১৬টি মিটিং করেছিলাম। সরকার আইন করেছিল। আইনের উদ্দেশ্য ছিল, মানুষ ভূগর্ভের পানি না টেনে যেন উপরিভাগের পানি ব্যবহার করে। কিন্তু সরকার উপরিভাগের পানি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়। কারণ শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরীÑএগুলোর পানি নষ্ট হয়ে গেছে। সরকার আবার সম্পূর্ণভাবে পাতালের পানির ওপরেই নির্ভর করেছে। ফলে ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা এবং আমাদের উন্নত শহরগুলো মাত্রাতিরিক্ত পানি উঠিয়ে নেয়ায় লেয়ার নিচে নিয়ে গেছে। এতে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক ও বর্তমানে ঢাকা হেড অফিসে দায়িত্বপ্রাপ্ত আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘ভূগর্ভস্থ পানি নিচের দিকে চলে গেলে সমস্ত প্রাণীকূলের জন্যই তা অ্যালার্মিং। আমাদের ভূমির বেশিরভাগ স্থান সিমেন্টেড করে ফেলেছি। পাকা স্থাপনা আমাদের এখানে দিন দিন বাড়ছে। বৃষ্টির পানিটা ভূগর্ভে রিচার্জ হচ্ছে না। তার ওপর ভূগর্ভের পানির ওপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে পরিবেশের ওপর ভয়াবহতার শঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।’