নারীর ক্ষমতায়নে পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

নুসরাত জাহান শুচি : বিবিসির ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ জরিপে ষষ্ঠ বাংলার মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া (২০০৪ সালের বিবিসি জরিপ অনুযায়ী)। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম হয়েছিল ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর এবং তার প্রচেষ্টায় বাংলায় নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের সূচনা করেন”সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে। নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ না পেলেও বাংলার নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদান ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, শিক্ষাব্রতী, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সমাজ সংস্কারক, বাঙালি চিন্তাবিদ, নারী জাগরণ ও নারী অধিকার আন্দোলনের একমাত্র পথিকৃৎ। বেগম রোকেয়ার জন্ম রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার অন্তর্গত পায়রাবন্দ গ্রামে। তার পিতা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের। তিনি একজন শিক্ষিত জমিদার ছিলেন। তার মা ছিলেন রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। রোকেয়ার দুই বোন করিমুননেসা ও হুমায়রা, আর তিন ভাই যাদের একজন শৈশবে মারা যায়। বড় বিচিত্র ছিল বেগম রোকেয়ার জীবন। তার পিতা আবু আলী হায়দার সাবের আরবি, উর্দু, ফারসি, বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন রক্ষণশীল। তবে তার বড় দুই ভাই ছিলেন বিদ্যানুরাগী ও আধুনিক মনস্ক। রোকেয়ার বড় বোন কামরুন্নেসাও ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও সাহিত্যানুরাগী। রোকেয়ার শিক্ষালাভ, সাহিত্যচর্চা এবং সামগ্রিক মূল্যবোধ গঠনের শুরু হয় বড় দু’ভাই ও বোন করিমুন্নেসার মাধ্যমে। তাদের সমর্থন ও সহায়তায় রোকেয়া বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি এবং আরবি আয়ত্ত করেন।

১৯৯৮ সালে তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, তদুপরি সমাজসচেতন, কুসংস্কারমুক্ত এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয়। উদার ও মুক্তমনের অধিকারী স্বামীর সহায়তায় তার সাহিত্যচর্চার শুরু হয়। এর মধ্যেই মহীয়সী এই নারীর স্বামী মারা যান ১৯০৯ সালে কিন্তু তিনি থেমে যাননি। কোলের ২ কন্যাসন্তানকে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন। নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আজীবন সংগ্রাম করেছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েদের ও তাদের পরিবারের লোকদের শিক্ষার গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। যেখানে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের যাত্রা শুরু করেন মাত্র ৫ জন ছাত্রী নিয়ে; কয়েক বছরের মধ্যে সেখানে ১০০ জন ছাত্রী ছাড়িয়ে যায়। তিনি ১৯১৬ সালে মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠান দুস্থ নারীদের লেখাপড়া ও হাতের কাজ শেখানো কাজ করে।

তিনি ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষাবিষয়ক সম্মেলনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সম্মেলনে রোকেয়া বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন, যা সেই সময়ের কোনোদিন নারীর জন্য ছিল দুঃসাহসিক কাজ। নারীদের পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন। তার মতে, নারী সহিংসতা প্রতিরোধে নারীদের প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। প্রয়োজনে লেডিকেরানি হতে শুরু করে লেডিম্যাজিস্ট্রেট, লেডিব্যারিস্টার, লেডিজজ সবই হতে হবে। তার মতে, স্বামীর গৃহে যে শ্রম দিয়ে নারীরা অবহেলিত হন সেই শ্রম বাইরে দিলে তারা স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করে মুক্তির স্বাদ পেতে পারেন। ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’  নামে একটি বাংলা গল্প লিখে তিনি বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করেন। এরপর আর ভাবতে হয়নি। একে একে লিখে ফেলেন মতিচূরের প্রবন্ধগুলো এবং সুলতানার স্বপ্নের মতো নারীবাদী বিজ্ঞান কল্পকাহিনি। ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, বিজ্ঞান কল্পকাহিনি ও শ্লেষাত্মক রচনায় রোকেয়ার স্টাইল ছিল স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। উদ্ভাবনা, যুক্তিবাদিতা এবং কৌতুকপ্রিয়তা তার রচনার সহজাত বৈশিষ্ট্য। তার লিখিত প্রবন্ধের বিষয় ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত। বিজ্ঞান সম্পর্কেও তার অনুসন্ধিৎসার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯০৫ সালে তার প্রথম ইংরেজি রচনা সুলতানাজ ড্রিম”মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় ছাপানোর পর সাহিত্যিক হিসেবে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। সুলতানার স্বপ্নকে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যে একটি মাইলফলক ধরা হয়।

প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গসমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। হাস্যরস আর ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপের সাহায্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর উপেক্ষা আর অবমাননার স্থান তুলে ধরেছেন। তিনি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন, ধর্মের নামে নারীর প্রতি অবিচার রোধ করতে চেয়েছেন, শিক্ষা আর পছন্দ অনুযায়ী পেশা নির্বাচনের সুযোগ ছাড়া যে নারী মুক্তি আসবে না তার প্রমাণ দিয়েছেন। তিনি নারীর অলংকারকে দাসত্বের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তার মতে, জেলখানায় দেয়া হয় লোহার শিকল আর নারীদের দেয়া হয় সোনার শিকল (চুড়ি, হার, পায়ের মল ইত্যাদি); যা নারীদের জন্য অবমাননাকর। তিনি আজীবন নারীদের আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত হয়ে আর্থ-রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে সচেষ্ট হতে আহ্বান জানিয়েছেন। তার রচিত মতিচূর প্রবন্ধসংগ্রহের প্রথম (১৯০৪) ও দ্বিতীয় খণ্ডে (১৯২২)। সুলতানার স্বপ্ন (১৯০৫), পদ্মরাগ (১৯২৪), অবরোধবাসিনী (১৯৩১) ইত্যাদি তার সৃজনশীল রচনাগুলো নারীবাদের অপর লিখিত দলিল স্বরূপ। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার আগে লেখাগুলো নবনূর, সওগাত, মোহাম্মদী ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। হাস্যরসের মাধ্যমে তিনি নারী সমাজের প্রতি পুরুষদের নির্যাতনের ছবি তুলে ধরেছেন।

নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ মহীয়সী এই নারীকে সম্মান জানিয়ে বাংলাদেশের রংপুর জেলার রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশে প্রথম কোনো নারীর নামে পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এটি। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালের নারীদের বসবাসের আবাসিক হলের নামকরণ করা হয় রোকেয়া হল। প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর নারী উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য বিশিষ্ট নারীদের বেগম রোকেয়া পদক দেয়া হয়। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ১৯৮০ সালে বেগম রোকেয়ার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ২টি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। ১৩৭তম জন্মদিনে গুগল তার হোম পেজে গুগল ডুগল প্রদর্শনের মাধ্যমে তার জন্ম দিন পালন করে। তার স্মরণে বাংলাদেশ সরকার গণ-উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র স্থাপন করেন। বাঙালি সমাজ যখন ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা আর সামাজিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল, সেই সময় বেগম রোকেয়া বাংলার মুসলিম নারী সমাজে শিক্ষার আলো নিয়ে এসেছিলেন। মহীয়সী এই নারী ছিলেন সমাজ পরিবর্তনের প্রবর্তক।

১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন বেগম রোকেয়া। কবর উত্তর কলকাতার সোদপুরে অবস্থিত। সে সময় তিনি ‘নারীর অধিকার’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। বাঙালি আধুনিক যুগের ইতিহাসে যে নারীর নাম গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয় সেই নাম হচ্ছে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন-বেগম রোকেয়া।

ক্ষণস্থায়ী মানব জীবনে নারীর ক্ষমতায়নের যে শুভ সূচনা তিনি করে গেছেন, তারই অনুসরণ করে আজ বাংলার নারীরা হয়ে উঠেছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট, শিক্ষক, পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্য। এমনকি আজ বাংলার শাসনভার ও কাঁধে তুলে নিয়েছেন মহীয়সী নারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার শিরীন শারমিন, মেজর জেনারেল সুসানে গীতি, প্রথম নারী রেলচালক সালমা খাতুনের মতো হাজারো মেয়ে। বেগম রোকেয়ার নারী জাগরণে উজ্জীবিত হয়ে শিক্ষাসহ সবক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসন করতে হবে। সমাজের কল্যাণে কাজ করার মাধ্যমে বেগম রোকেয়াকে স্মরণীয় করে রাখতে হবে।

শিক্ষার্থী ২য় বর্ষ, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়