আবু সালেহ মোহাম্মদ মুসা: বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। নতুন প্রজš§ আলোর পথে এগিয়ে যাবে এ আমাদের প্রত্যাশা। দেশের উন্নয়ন তথা জাতির উন্নয়নের সঙ্গে নারী ও শিশুর উন্নয়ন জড়িত। তাই সরকার এদিকে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করেছে। আমাদের উচিত সবাইকে এ উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করা। সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলেই জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় স্থায়ীভাবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব।
সংবিধানের ১৯, ২৭, ২৮ ও ২৯ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ এবং নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিকার ও প্রতিরোধে কার্যক্রম জোরদারসহ সব ক্ষেত্রে নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। নারীর শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধিত হয়েছে। বর্তমানে মুসলিম বিশ্বসহ যুক্তরাষ্ট্র, চীনের মতো উন্নত দেশগুলোর চাইতেও বাংলাদেশ জেন্ডার বৈষম্য হ্রাসের ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় জেন্ডার বৈষম্য হ্রাসে বর্তমানে বাংলাদেশ শীর্ষে অবস্থান করছে।
উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত রাখতে সরকার চলতি অর্থবছরে ৪৪টি মন্ত্রণালয়-বিভাগের নারীদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ সংবলিত জেন্ডার বাজেট পেশ করেছে। ঠিক একইভাবে শিশুদের উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সরকার অগ্রাধিকার দিয়েছে। এ বছর সরকার জাতীয় বাজেটের ১৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ অর্থাৎ ৮০ হাজার ২০০ কোটি টাকা নারী ও শিশু উন্নয়নে বরাদ্দ রেখেছে। গত বছর এ বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৬৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় নারী আজ সমাসীন। কখনও বা নারীর বেশে, আবার কখনও পুরুষের হাতে হাত রেখে। দিনে দিনে ক্রমাগত উন্নয়নের এ যাত্রা অব্যাহত রেখেছে উভয়ে। এর ফলে আজকের এ যুগে পদার্পণ করেছে নারী। নারী এখন আগের তুলনায় অনেক স্বাধীন। নারীর উন্নয়ন, নারীর দক্ষতায়ন, নারীর ক্ষমতায়ন সর্বোপরি নারীকে এখন উপযুক্ত মায়ের দায়িত্ব নিতে হয়।
এ কথা সত্য, যুগে যুগে নারীর অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। বেড়াজালে আবদ্ধ রেখে, গণ্ডির মধ্যে নিয়োজিত রেখে নারীর উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। সময়ের পরিবর্তনে শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে প্রজ্বলিত হতে থাকায় এ ঘোর অমানিশা কাটতে শুরু করে। আজ ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ছে আর মানুষের চোখ উম্মোচিত হচ্ছে বিস্তারিত জানতে নিজেদের যোগ্যতম আসনে অধিষ্ঠিত করতে। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য তাকে উপযুক্ত স্থানে অধিষ্ঠিত করতে হবে আর এজন্য চাই নারীর দক্ষতায়ন। শিক্ষাদীক্ষা, অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা এবং নারীর প্রকৃত দক্ষতার সদ্ব্যবহার করে উপযুক্ত স্থানে নিয়োজিত করতে পারলে নারীর ক্ষমতায়ন ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন অনেকাংশে নিশ্চিত হবে।
নারী ও শিশুর উন্নয়নে পরিকল্পনা হতে হবে বিশ্বব্যাপী। মাদকের অপব্যবহার, সহিংসতা রোধ, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়তে নারী এবং শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে কাজ করতে হবে। সার্বিক চিকিৎসা সুবিধা সবার জন্য নিশ্চিত করতে হবে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাপী সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে নতুন প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবীর আশায়। আমাদের দেশ, আমাদের নারীরা এর বাইরে নয়।
‘নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৮-২০৩০’ যুগোপযোগী করার জন্য সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে বিভিন্ন সেমিনারের মাধ্যমে জেলা ও উপজেলা পর্যায় থেকে উঠে আসা উল্লেখযোগ্য বেশকিছু প্রস্তাব গ্রহণ করছে। এগুলোর মধ্যে শিশুদের গৃহকর্মে নিয়োজিত না করা; গণপরিবহনের মালিক, ড্রাইভার ও শ্রমিকের আচরণ কেমন হবে তার একটি নীতিমালা তৈরি করা; প্রতিটি গাড়িতে জিপিএস ট্র্যাকিংয়ের সিস্টেম চালু করা; ট্রাভেল এজেন্সিগুলোকে জেলা প্রশাসনের আওতায় মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা; অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহারে বয়সসীমা নির্ধারণ করা; বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন করা; যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ঋণ প্রদান করে আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখা এবং জেলা তথ্য অফিসের মাধ্যমে জনগণের জন্য নির্যাতন প্রতিরোধমূলক ছবি ও গান প্রদর্শন করা।
ইতোমধ্যে সরকারি উদ্যোগের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হলেও নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হওয়া খুবই জরুরি। এজন্য পরিবার থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। বাসায় আমরা যদি নারীর প্রতি সহিংসতা থেকে বিরত থাকি এবং আমাদের ছেলে-সন্তানদের নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে শিক্ষা দিতে পারি, তবে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করা সম্ভব হবে, সমাজে পরিবর্তন আসবে। এ ক্ষেত্রে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ভূমিকা ব্যাপক।
নারী ক্ষমতায়নের অন্যতম অন্তরায় হচ্ছে কর্মস্থল ও গণপরিবহনে যৌন হয়রানি। একজন নারী তার কর্মস্থলে যদি স্বাধীন সত্তা নিয়ে নিরাপদ পরিবেশে কাজ করতে না পারে অথবা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, তাহলে নারীর উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। নারীর ওপর এসব নির্যাতন এবং হয়রানির বিচার না হলে অনেক নারীই হতাশাগ্রস্ত এবং কর্মবিমুখ হয়ে পড়বে, যা নারীর ক্ষমতায়ন ও দক্ষতায়নের পথে অন্তরায় এবং সুস্থ সমাজ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
সরকার সমাজের পিছিয়ে পড়া ও সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তি, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের অধিকার ও সুবিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেছে। পরিবারকেন্দ্রিক নারীর প্রতি এসব শারীরিক ও মানসিক সহিংসতা প্রতিরোধে সরকার ২০১০ সালে ‘পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন’ এবং ২০১৩ সালে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ বিধিমালা প্রণয়ন করেছে। কিন্তু এ আইন সম্পর্কে জনগণ এখনও পুরোপুরি অবগত হয়নি। এ আইন সম্পর্কে বিস্তারিত গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে নারী-পুরুষ উভয়ই সচেতন হবে এবং সমাজে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে, নারী ও শিশুর প্রতি সবার দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন আসবে।
সরকার নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুবিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বিনা খরচে তাদের সরকারি আইনি সেবা প্রদান করছে। ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন-২০০০’কে নারীবান্ধব আইন উল্লেখ করে সম্প্রতি আইনমন্ত্রী বলেন, এ আইনের আওতায় নারী সেবাগ্রহীতার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শারীরিক ও মানসিকভাবে সহিংসতার শিকার নারীরা এখন ঘরে বসেই জাতীয় আইনগত সহায়তা আইনের অধীনে ‘১৬৪৩০’ হেল্প লাইনে ফোন করে সরকারি আইনি সেবা নিচ্ছেন। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, গত এপ্রিল পর্যন্ত এক লাখ ৮৫ হাজার ২৮৬ জন নারী বিনা খরচে সরকারি আইনি সেবা নিয়েছেন।
সরকারি এ আইনি সহায়তা কার্যক্রম এখন ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত। নারী নির্যাতনের অনেক খবর সরকারের কাছে পৌঁছায় না। তাই নারীর প্রতি সহিংসতার অভিযোগ পেলে তা লিগ্যাল এইড অফিসে পৌঁছানোর বিষয়ে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে নারীদের আরও সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
শিশু অধিকার বা শিশু সুরক্ষা বলতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে একইভাবে আমরা বুঝি কোনো শিশু লাঞ্ছনা, অবহেলা বা বঞ্চনার শিকার হবে না, প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকারগুলো যেমন যত্ন ও সুরক্ষা এবং ন্যায্য বিচার সুরক্ষিত হবে এবং শিশুটি সামগ্রিকভাবে বিকাশ লাভ করবে। শিশুরা লাঞ্ছনা, পাচার, শিশুশ্রম এবং ক্ষতিকর কিছু গতানুগতিক প্রথা যেমন কন্যা ভ্রুণ হত্যা, অপুষ্টি, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত আপদকালীন জরুরি অবস্থা, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ সব নারী ও শিশুর বিশেষ সুরক্ষার প্রয়োজনের কথা চিন্তা করতে হবে এবং উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
আমাদের প্রত্যাশা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে আমাদের সব গুণাবলি যেন বিশ্বে মডেল হিসেবে পরিগণিত হয়। এ জন্যই নারী ও শিশুর উন্নয়নে সম্মিলিতভাবে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য মিডিয়া, পরিবার ও সমাজের সবার ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করতে হবে। তবেই আমরা সুখী, সমৃদ্ধশালী দেশ পাব।
পিআইডি নিবন্ধ