আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: রাষ্ট্রের জনসংখ্যার অধিকাংশই নারী। নারীরা এখন যেকোনো কাজের সফলতা পেছনে থেকেই ভূমিকাই শুধু রাখছে তাই নয়, এখন তারা নিজের সফলতার খাতা খুলতে শিখেছে। প্রতিটা ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে অবদান রাখছে। নারীরা তাদের মেধা, শ্রম, সাহসিকতা, শিক্ষা ও নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের দেশ গঠনে কাজ করে যাচ্ছেন এবং একই সঙ্গে ভূমিকা রাখছেন একটি স্বাবলম্বী শিক্ষিত প্রজš§ গঠনে। আর তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাতীয় সংসদে (পার্লামেন্টে)। নারী-পুরুষের সমতা অনুধাবনের অন্যতম মাপকাঠি হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নারী-পুরুষের আনুপাতিক অবস্থান।
নারীরা নিজের যোগ্যতায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে বিচারকার্যে, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, বিজ্ঞ আইনজীবী ও উন্নয়ন কর্মী এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এছাড়া নারীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য আছে। এতে বিস্মিত বা আশ্চার্যান্বিত অথবা ঈর্ষান্বিত হওয়ার কিছুই নেই। অনেক নারী নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে প্রতিকূল পরিবেশ সংগ্রাম করে। প্রতিষ্ঠিত হতে গিয়ে সমাজের কিছু মানুষের তিরস্কার শুনতে হয়েছিল। কোনো এক সময় নারীরা কৃষি কাজ, ঘরের বাইরে কাজ করা, বাইসাইকেল চালানো ইত্যাদি কাজকেও সমাজের কিছু অংশ বাঁকা চোখে দেখতেন। জীবন ও জীবিকার তাগিদে নারীরা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষ থেকে এখন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্বের অবস্থান করছে। নেতৃত্বের সঙ্গে যোগ্যতার সম্পর্ক রয়েছে। যোগ্যতা না থাকলে নেতৃত্ব দেয়া যায় না। নারীর নেতৃত্ব ও যোগ্যতা নির্বাহী বিভাগই শুধু নয়, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ বিচার বিভাগেও। নি¤œ আদালতের বিচারকের মধ্যেই শুধু সীমাবদ্ধ নয়, উচ্চ আদালতেও রয়েছে নারী বিচারক এবং নারী নিজের কর্মযোগ্যতায় হয়েছেন বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মহাপরিচালক। জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনেও বিচারক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে বেশ কিছু বাংলাদেশের নারী বিচারক। বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়েছেন নারী।
রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীর অংশগ্রহণের বিষয় বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে অষ্টম হলেও জাতীয় রাজনৈতিতে ক্ষমতায়নে তারা পিছিয়ে রয়েছে। জাতীয় সংসদে যেসব নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন তাদের বেশি ভাগ সদস্য (৫০ জন বিশেষ আসনের সংসদ) সংরক্ষিত নারী সদস্য। যারা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট নির্বাচিত সংসদ সদস্য নয়। বাংলাদেশের বর্তমান সংসদে ৩৫০ জন সদস্যের মধ্যে ২৩ জন নারী সরাসরি প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত, বাকিরা সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য। জাতীয় রাজনৈতিতে ক্ষমতায়নের সঙ্গে মর্যাদায়নে বাংলাদেশের নারীরা কেন পিছিয়ে থাকবেন? নারীরা সংরক্ষিত কোঠায় থাকবে কেন? তাদেরই সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়, যারা বিলুপ্ত হওয়া পথে চলছে। সময় অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে, এখন নারীদের প্রত্যক্ষ নির্বাচনের সুযোগ দেয়া রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব। যদিও বিগত ৩৫ বছরের বেশি সময় বাংলাদেশে নারীই মাননীয় প্রধান বিরোধী দলের নেতা ও নেতৃত্বে আছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দলের দায়িত্বে আছেন ৩০ বছরের অধিক সময়। মহান জাতীয় সংসদে মাননীয় স্পিকার দায়িত্বে রয়েছেন প্রায় ১০ বছর। তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত যোগ্যতা থাকার পরও পারিবারিক রাজনৈতিক শক্তি এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে ওই পদগুলোতে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু যেসব নারীর পেছনে শক্তিশালী পরিবার নেই, তারা অনেক সংগ্রাম করেও জাতীয় রাজনীতিতে উঠে আসতে পারছেন না। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারীদের আরও বেহাল অবস্থা। প্রতিটি প্রত্যক্ষ নির্বাচনে বিজয়ী নারী সদস্য (নারী জনপ্রতিনিধি) ৩ জন পুরুষ জনপ্রতিনিধির এলাকার প্রতিনিধিত্ব করলেও জনগণের জন্য কাজ করার সুযোগ পান একজন পুরুষ জনপ্রতিনিধি (সদস্য) থেকেও অনেক কম। এগুলো নারী ক্ষমতায়ন ও মর্যাদায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এখান থেকে আমাদের রাষ্ট্রকে বেরিয়ে আসতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশ নারীর ক্ষমতায়ন ও মর্যাদায়নে অনেক সামনে অগ্রসর হয়ে গিয়েছে। আমাদের রাষ্ট্র পিছিয়ে থাকবে কেন? যেখানে আমরা স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তী পালন করছি। আশা করি, রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিক সদ্বিচ্ছার মাধ্যমে এসব সমস্যার উত্তরণ হবে এবং বাংলাদেশে কোনো একদিন নারী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন।
সম্প্রতি পার্লামেন্টে নারীর উপস্থিতি বাড়লেও এখনও নারী-পুরুষের ব্যবধান অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমতায় পৌঁছাতে আরও ৫০ বছর লাগতে পারে, জাতিসংঘের অংশীদারি প্রতিষ্ঠান ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘ কার্যালয়ে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। ওই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আইপিইউর মহাসচিব মার্টিন চুনগং, পার্লামেন্টে নারী-পুরুষ বৈষম্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।
জাতিসংঘের অংশীদারি প্রতিষ্ঠান ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ’র) প্রতিবেদন মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় পার্লামেন্টে নারী সদস্যের হার ১৭ শতাংশের কিছু বেশি। দেশ হিসেবে নেপালের পার্লামেন্টে নারী সদস্য সবচেয়ে বেশি। দেশটিতে নি¤œকক্ষে ৩২ দশমিক ৭ শতাংশ ও উচ্চকক্ষে ৩৭ দশমিক ৯ শতাংশ নারী সদস্য। আফগানিস্তানের পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষে নারী সদস্যের হার ২৭ শতাংশ, উচ্চকক্ষে তা প্রায় ২৮ শতাংশ।
বিশ্বের প্রতি চারজন পার্লামেন্ট সদস্যের একজন নারী, (আইপিইউ) প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্বে ২০২০ সালে পার্লামেন্টে নারী সদস্যের সংখ্যা শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে। রুয়ান্ডায় দুই কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার নি¤œকক্ষে নারী সদস্যের হার ৬১ দশমিক ৩ শতাংশ। উচ্চকক্ষে ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ। কিউবা ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে যথাক্রমে ৫৩ দশমিক ৪ শতাংশ ও ৫০ শতাংশ। আইপিইউর প্রতিবেদনের তথ্যমতে, নিউজিল্যান্ডে গত বছরের সাধারণ নির্বাচনের পর গঠিত নতুন পার্লামেন্টে নারী সদস্যের হার দাঁড়িয়েছে ৪৮ শতাংশের বেশি।
অস্ট্রেলিয়ায় এ হার ৩১ শতাংশ। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষে নারী সদস্যের হার ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ, উচ্চকক্ষে প্রায় ২৮ শতাংশ। জার্মানির নি¤œকক্ষে এ হার ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ, উচ্চকক্ষে ৩৬ শতাংশের কিছু বেশি। অন্যদিকে কানাডার পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষে নারী সদস্যের হার ২৯ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে উচ্চকক্ষে তা ৪৯ শতাংশের বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নি¤œকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে নারী সদস্যের হার ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ, উচ্চকক্ষ সিনেটে ২৫ শতাংশ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন একজন নারী। আর চীন ও সৌদি আরবের পার্লামেন্টে নারী সদস্যের হার যথাক্রমে ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ ও ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ। এর মধ্য দিয়ে পার্লামেন্টে নারীর সংখ্যা ২৫ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছেছে। তাই রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীর অংশগ্রহণের বিষয় বিবেচনায় বাংলাদেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রকৃত নারীর মর্যাদা ও ক্ষমতায়নে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয়া সময়ের দাবি।
আইনজীবী
masumbillahlaw06@gmail.com