নারীর মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি

পারভেজ বাবুল: নারীদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের মধ্যে একটি সম্পর্ক রয়েছে। আমি চিকিৎসক নই। একজন সাংবাদিক হিসেবে পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যসম্পর্কিত সমস্যাগুলোর কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছি।
জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের (এমডিজি) আটটি লক্ষ্যের মধ্যে পঞ্চমটি হলো মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি করা। এটি নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার, নিরাপদ গর্ভাবস্থা এবং নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করার ওপর নির্ভর করে। বিষন্নতা একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যা সন্তান জন্মের বছরগুলোতে পুরুষদের তুলনায় নারীরা দ্বিগুণ ভোগে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অনুধাবন করেছেন প্রজনন স্বাস্থ্য, সাধারণ শারীরিক স্বাস্থ্য, ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্কের গুণগত মান এবং শিশুর প্রতি আচরণগুলো প্রতিনিয়ত দুর্দশাগ্রস্ত মায়েদের দ্বারা মূল্যায়ন করানো উচিত। ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্য বিভিন্ন দেশের জনস্বাস্থ্য পেশাদাররা একত্রিত হয়েছিলেন। তারা বলেন, ‘এরই মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন স্বাস্থ্যসম্পর্কিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যে অগ্রগতির জন্য একটি গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করেছে।’ উপরন্তু সিডর, আইলা, বন্যা বা দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য উপেক্ষা করা হয়। লাগাতার বিপর্যয়ে নারী ও কন্যাশিশুরা আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। অথচ এটি মহান উদ্বেগের হওয়া উচিত ছিল।
নাইমা একজন পোশাক শ্রমিক। তিনি আমাকে জানালেন, তার প্রেমিক তাকে অন্তর্মুখী বলে সম্বোধন করেন। অথচ তার প্রেমিক কখনও তার দুঃখ ও অনুভূতিগুলোকে অনুধাবন করতে পারেন না। আবার এটাও অনুধাবন করেন না যে, কম বেতন দিয়ে সংসার চালানোর জন্য তাকে কতটা মানসিক চাপ সহ্য করতে হয়! কেননা তিনি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তিনি আরও বলেন, নারীদের মুখ বন্ধ রাখতে দারিদ্র্য, বিষন্নতা ও অসুস্থতা চাপ সৃষ্টি করে; ফলে তারা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো গোপন রাখেন। তার মতো এমন হাজার হাজার দরিদ্র যুবতী আছে। তাই নারীদের কথাগুলো পুরুষদের শুনতে হবে এবং নারীদের শারিরীক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্য সুস্থ-সবল রাখতে মনোযোগসহ তাদের মন (মানসিক অবস্থা) বুঝতে হবে।
প্রতিবন্ধীদের প্রসঙ্গে এ পরিসরে আমি মেক্সিকোর এক নারীর একটি মন্তব্য উল্লেখ করছি। তার নাম চেচেমি। তিনি শারীরিকভাবে অক্ষম মেয়ে ও নারীদের যৌন বাসনা সম্পর্কে বললেন, এটি উপেক্ষা করা হলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য প্রভাবিত হয়। তিনি লিখেছেন, ‘আমি বলতে ভয় পাই না, সারা বিশ্বের প্রতিবন্ধী তরুণীরা তাদের সঙ্গী ও পরিবারের সঙ্গে আকর্ষণ অনুভব, যৌন হতাশা এবং জ্ঞাপনের অভিজ্ঞতা ভোগ করে। আমাদের প্রশ্ন ও উদ্বেগ আছে, গল্পগুলো বলুন; সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, স্বীকার করার মানসিকতা থাকা চাই।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুসারে, নারীদের সহিংসতা-সংক্রান্ত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো খুবই দুর্বলভাবে চিহ্নিত করা হয়। চিকিৎসকরা সরাসরি সহিংসতা শিকারের ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস না করা পর্যন্ত তা নারীরা প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক। সংস্থাটি এ বিষয়ে উল্লেখ করে
এক. পুরুষদের সঙ্গে বিষন্নতা (ডিপ্রেশন) সমস্যার তুলনায় নারীরা ৪১ দশমিক ৯ শতাংশ নিউরো সাইক্রিয়াটিক সমস্যায় আক্রান্ত, যা পুরুষদের ক্ষেত্রে মাত্র ২৯ দশমিক তিন শতাংশ।
দুই. বৃদ্ধদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর মধ্যে বিষন্নতা (ডিপ্রেশন), অর্গানিক ব্রেইন সিনড্রোম ও ডিমেনশিয়া, যার বেশিরভাই নারীদের হয়।
তিন. আনুমানিক ৫০ মিলিয়নের মধ্যে শতকরা ৮০ শতাংশ মানুষ (যার বেশির ভাগই নারী ও শিশু) সহিংস সংঘাত, গৃহযুদ্ধ, দুর্যোগ ও উৎখাতের শিকার।
চার. মহিলাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার হার ১৬ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত।
পাঁচ. প্রতি পাঁচজনের মধ্যে কমপক্ষে একজন নারী তার জীবনকালে ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছেন।
বিভিন্ন দেশে বিষন্নতা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, মানসিক যন্ত্রণা, যৌন সহিংসতা ও গার্হস্থ্য সহিংসতার হার ক্রমবর্ধমান, যা পুরুষদের চেয়ে নারীদের বেশি পরিমাণে প্রভাবিত করে। ক্ষুধা, অপুষ্টি, অতিরিক্ত কাজ, গার্হস্থ্য সহিংসতা ও যৌন নির্যাতনের দ্বারা সৃষ্ট চাপগুলো নারীদের দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য দায়ী। এ প্রসঙ্গে ডা. ইশরাত ফেরদৌসী বলেন, ‘মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা হচ্ছে মানুষ হিসেবে নারীদের মৌলিক অধিকার। এটি নিশ্চিত করার জন্য কন্যাশিশুদের পুষ্টি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রভৃতিতে মেয়ে ও ছেলেকে সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে সর্বপ্রথম পরিবারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। নারীদের সব অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সমাজকে বহন করতে হবে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক উভয় ক্ষেত্রেই সফলভাবে নিরাপত্তা প্রদানে সহায়তা করবে। তাই আমি মনে করি, আমাদের রাষ্ট্র ও সুশীল সমাজের পাশাপাশি নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পরিবারের আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিত।’
নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ রয়েছে। যথা
এক. নারী ও মধ্যস্থতাকারী এবং প্রতিরক্ষামূলক বিষয়গুলোর ওপর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর ব্যাপকতা ও কারণগুলোর প্রমাণ তৈরিকরণ।
দুই. স্বাস্থ্যের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, যা নারীর চাহিদা এবং শৈশব থেকে বৃদ্ধ বয়সের উদ্বেগকে মোকাবিলা করবে।
তিন. গৃহ সহিংসতা, যৌন নির্যাতন-নিপীড়ন এবং মহিলাদের মধ্যে তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী মানসিক যন্ত্রণা ও স্বাস্থ্যের পরিণতি শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসা করার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহকারীদের দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ।
সর্বোপরি নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশ এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কন্যা ও নারীদের বিরুদ্ধে কটূক্তি, বৈষম্য ও সহিংসতা প্রতিরোধ করতে হবে। তাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা যদি সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি তাহলে জাতিসংঘ থেকে মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি)’ পুরস্কার পেতে পারি। সে হিসেবে আমাদের প্রতিবছর কন্যাসন্তানের জন্য দিনটি স্মরণীয় করে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় নির্বাচন করা উচিত। শিক্ষাবিদ মাহবুবা আমাকে বলেছিলেন, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাটি পাঠ্যক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যাতে শিক্ষার্থীরা মানসিক ব্যাধি বা সমস্যাগুলো প্রতিরোধ করা সম্পর্কে জানতে পারে। প্রবাদে আছে, ‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম।’
দেশীয় প্রেক্ষাপটে অফিস-আদালতে অনেক উচ্চপদস্থ পুরুষ কর্মকর্তা লিঙ্গ সংবেদনশীল হন না। তাদের অনুধাবন করা প্রয়োজন নারীরা তাদের কাছ থেকে তেমন মনোযোগ আকর্ষণ করে না, তারা শুধু পুরুষ সহকর্মীদের মতো একই কাজ করতে চায়। এ ছাড়া বাড়িতে ও অফিসে কাজ করা সম্পর্কে স্ত্রীদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। অতিরিক্ত মানসিক ও শারীরিক চাপের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও নারীরা স্বামী, সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ি ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য তাদের চাহিদা ও চাওয়া-পাওয়াগুলো ত্যাগ করে। তাই নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য বুঝে ওঠা মূলধারার স্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্য হওয়া উচিত। লিঙ্গ সংবেদনশীল মানসিক স্বাস্থ্য পরিকল্পনা, গবেষণা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা সরকারের উচিত। নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য প্রচার-প্রচারণা, অনুপ্রেরণা, ইতিবাচক চিন্তাভাবনা এবং অনুকূল পরিবেশের প্রয়োজন।
সুস্মা একটি মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘বহু বৈবাহিক সম্পর্ক এখন আমাদের সমাজে একটি আলোচিত বিষয়। বহু বৈবাহিক সম্পর্কের সঙ্গে জড়িত নারীরা অবহেলার কথা উল্লেখ করেছেন তারা স্বামীদের কাছ থেকে অপর্যাপ্ত সময়-সমর্থন-যত্ন এবং যৌন অসন্তোষ পেয়েছেন। এটি মানসিক ব্যাধি, সহিংসতা ও অপরাধ সৃষ্টি করে। সুতরাং স্ত্রী বা প্রেমিকাদের সঙ্গে সমস্যাযুক্ত পুরুষদের সম্পর্ককে সুস্থ, অর্থপূর্ণ ও দীর্ঘস্থায়ী রোমান্স এবং প্রেমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার পরিবর্তে পুরুষদের আচরণকে দ্বিগুণ দোষী বলে অভিহিত করা উচিত।’ সর্বোপরি, নারীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এবং কাক্সিক্ষত প্রশান্তির লক্ষ্যে কোনো অনীহা জ্ঞাপন করা যাবে না। নারীদের সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে তুলতে পারলে নারী-পুরুষ সহাবস্থান, সম-অধিকার সুনিশ্চিত হওয়াসহ ধারাবাহিক উন্নয়ন সাধিত হবে বলে আশা করছি।

পারভেজ বাবুল: গণমাধ্যমকর্মী

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মোহাম্মদ অংকন