নালায় পরিণত হয়েছে পুরাতন খোয়াই নদী

কাজল সরকার, হবিগঞ্জ: হবিগঞ্জ শহরের বুক চিরে বয়ে চলা যে নদীটি এক সময় ছিল শহরের প্রাণ, দখলে-দূষণে সে নদীই এখন মৃতপ্রায়। সারা দেশেই সমান পরিচিত খোয়াই নদীর জায়গা দখল করে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে স্থাপনা, কমছে নদীর প্রশস্ততা আর পানিপ্রবাহ। নদীতে ফেলা হচ্ছে পানি দূষণকারী ভয়ঙ্কর সব বর্জ্য। ফলে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ভালোভাবে শ্বাস নেওয়াটাও এখন দায়। দুবছর আগেও যে পুরোনো খোয়াই নদীতে পানি ছিল, স্রোত ছিল; এখন তার চিত্র দেখলে মনে হবে নদীর কোনো চিহ্ন ছিল না। তিলে তিলে হারিয়ে যাওয়ার পথে এক সময়ের খরস্রোতা খোয়াই নদী।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বার বার দখলমুক্ত করার দাবি জানালেও অদৃশ্য কারণে তৎপর হয়নি প্রশাসন। এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন পর হবিগঞ্জ শহর থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে পুরোনো খোয়াই নদীর অস্তিত্ব। খোয়াই নদী উদ্ধার করে তার পাশে পার্ক নির্মাণ করলে বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি নদী পুনরুদ্ধারের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হবে বলেও জানিয়েছেন তারা। এসব অভিযোগের জবাবে নদী উদ্ধার করে সেখানে দৃষ্টিনন্দন পার্ক নির্মাণ করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় সংসদ সদস্য।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৭৮-৭৯ সালে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে খোয়াই নদীকে শহর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার বাইরে নেওয়া হয়। এরপর থেকে পুরোনো খোয়াইয়ের দুই পাড়ে দখলদারদের দৃষ্টি পড়ে। নদী দখল করে অট্টালিকা তৈরি করছেন শহরের প্রভাবশালীরা। অবৈধ এসব দখলদারের তালিকায় রয়েছেন ডাক্তার, সাংবাদিক, সরকারি কর্মকর্তা, আইনজীবী, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ীসহ জনপ্রতিনিধিরাও।

প্রতি মাসেই জেলা আইনশৃঙ্খলা সভায় অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। ব্যাপক তোড়জোড় নিয়ে প্রশাসন মাঠেও নামে। নেওয়া হয় ৩৩ কোটি টাকার প্রকল্পও। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তা কিছুদিন পরই স্তিমিত হয়ে পড়ে।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, শহরের মাছুলিয়া থেকে হরিপুর পর্যন্ত পুরোনো খোয়াই নদীর দৈর্ঘ্য পাঁচ কিলোমিটার। আর এখানে অবৈধ দখলদারের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। এই খোয়াই নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত রাখতে পুরোনো খোয়াই নদী রক্ষা কমিটির নামে একটি কমিটি গঠন করা হয় ২০১২ সালে। সে সঙ্গে এ নদী রক্ষার্থে আন্দোলন করে যাচ্ছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনসহ (বাপা) কয়েকটি সামাজিক সংগঠন।

বাপার হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল জানান, পুরোনো খোয়াই নদী রক্ষা কমিটি ও বাপাসহ কয়েকটি সামাজিক সংগঠন পুরোনো খোয়াই নদী দখলমুক্ত, সীমানা চিহ্নিতকরণ ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণের দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু অজানা কারণে প্রশাসন নীরব।

এ বিষয়ে হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ সাহিদুল আলম জানান, নদীর পাঁচ কিলোমিটার অংশ লুপ কাটিং করার আগে নদীর প্রস্থ ছিল স্থানভেদে ২৫০ থেকে ৩০০ ফুট এবং গভীরতা ছিল ২৫ থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত। কিন্তু বর্তমানে পুরোনো খোয়াই নদী শহরের সর্ববৃহৎ ডাস্টবিনে রূপ নিয়েছে।

এছাড়া এ নদীর বাকি অংশ সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় সরকার, বিশ্বব্যাংক ও পৌরসভার সমন্বয়ে কাজ করার কথা রয়েছে। কিন্তু জেলা পরিষদের সামনে এবং শহরের মাহমুদাবাদের পশ্চিম ও শায়েস্তানগর এলাকার পূর্বদিক, মুসলিম কোয়ার্টার, নিউ মুসলিম কোয়ার্টার, সিনেমা হল, উত্তর শ্যামলী এলাকায় পুরোনো খোয়াই নদীতে দীর্ঘদিন ধরে ময়লা-আবর্জনা ফেলে দখল করে বাড়ি নির্মাণ করছে একটি মহল। এছাড়া ময়লার গন্ধে ভারি হয়ে উঠেছে পরিবেশ।

পৌর মেয়র জিকে গউছ বলেন, খোয়াই নদী দখল ও দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রশাসন বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এখন এ নদী দখল ও দূষণমুক্ত হবেই।

সুখবর শুনিয়েছেন জেলা প্রশাসক মনিষ চাকমা। তিনি বলেন, অচিরেই নদী পুনরুদ্ধার করে সেখানে একটি দৃষ্টিনন্দর পার্ক স্থাপন করা হবে। আর পার্ক নির্মাণের জন্য এলজিইডি সহযোগিতা করবে জানিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ আবু জাকির সেকান্দার বলেন, প্রশাসন পুরোনো খোয়াই নদী উদ্ধার করলে নদীর দুই তীরে সুন্দর রাস্তা নির্মাণ করা হবে।

নদী পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রাখতে চান স্থানীয় সংসদ সদস্যও। হবিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মো. আবু জাহির জানান, অর্থ ছাড় পেলে এ সরকারের আমলেই নদীর দু’পাড়ে ওয়াকওয়ে নির্মাণসহ নান্দনিক পার্ক উপহার দেওয়া হবে শহরবাসীকে।